ছয় মাসে তিন সিরিজ—আপনার অভিনীত চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ক্যারিয়ারের সেরা সময় যাচ্ছে? প্রশ্ন শুনে একটু সময় নিলেন। এরপর বললেন, ‘মুক্তি পাওয়ার সময়টা হয়তো কাছাকাছি। “ফেউ” অনেক আগে করা, “গুলমোহর”ও। তিনটি কাজ একই সময়ে মুক্তি পাওয়ার কারণে হয়তো এমন মনে হচ্ছে। আমার কাছে আলাদা কিছু মনে হচ্ছে না।’
আমি কমার্শিয়াল সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম—এই দুটি জনরাকে ভাগই করতে চাই না। ফিল্ম ইজ ফিল্ম। ঋতুপর্ণ ঘোষের “আবহমান” সিনেমায় একটা সংলাপ আছে, “সিনেমায় মুহূর্তই সব”। যদি ব্যবসা করে, তাহলে হিট ছবি আর ব্যবসা না করলে ফ্লপ। কোনোটা ভালো ছবি, কোনটা খারাপ ছবি—এই তো। ছবিকে আলাদা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না
মোস্তাফিজুর নূর ইমরান
‘রঙিলা কিতাব’-এর প্রদীপ, ‘ফেউ’-এর মার্শাল, ‘গুলমোহর’-এর রানা—মোস্তাফিজুর অভিনীত তিন চরিত্রের মধ্যে একধরনের আত্মিক যোগাযোগ আছে; তিন চরিত্রকেই তাড়া করে ফেরে অতীত। এই অতীতযোগ নিয়ে কি ভেবেছেন? ‘চরিত্রগুলোকে আমাকে অনেক দিন যাপন করতে হয়েছে। একটা যোগ থাকলেও চরিত্রগুলোর ধরন কিন্তু আলাদা। প্রদীপ খুব তাড়ার মধ্যে থাকে, মার্শাল চরিত্রের জন্য আমাকে ওই চরিত্রটা যাপন করতে হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এই ব্যাপারটা আপনারা হয়তো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। আমি খুব আরাম করে অভিনয় করেছি। আর রানার ক্ষেত্রে (নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ) শাওকী ভাই সবকিছু এত ভালোভাবে গুছিয়ে দিয়েছেন, আমাকে আলাদাভাবে কিছু চিন্তা করতে হয়নি,’ বললেন মোস্তাফিজুর। তাঁর অভিনীত এই তিন চরিত্রই বাইরে শক্তিশালী পুরুষ। কিন্তু বাইরের খোলসটা খুলে পড়লেই সবাই অসহায়। অভিনেতা বললেন, সব মানুষই কখনো না কখনো ভেঙে পড়ে; কেউ প্রকাশ করে কেউ করে না। শুটিং শুরুর প্রস্তুতির সময় তিনি চরিত্রগুলোর দর্শন বোঝার চেষ্টা করেছেন। রানা আর প্রদীপ—দুজনই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কিন্তু দুজনের ধরনটা আলাদা।
পর পর তিনটি কাজ আসার আগে একটা দীর্ঘ বিরতি ছিল; অনেক দিনই তাঁকে পর্দায় দেখেননি দর্শক। এই অপেক্ষা আপনার জন্য কতটুকু কঠিন ছিল?
‘রঙিলা কিতাব’–এ মোস্তাফিজুর নূর ইমরানহইচইয়ের সৌজন্যে
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মোস্তাফিজুর নিজেই ফিরে গেলেন অতীতে। তাঁর অভিনয়জীবনেও আছে ‘তাড়া করা অতীত’। বললেন, তাঁর জীবনেও সবকিছুতেই অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথম সিনেমা “সীমান্তের চড়ুইভাতি” মুক্তি পেয়েছে অনেক বছর পর। আরেকটি ছবি “আমরা একটা সিনেমা বানাবো” পাঁচ বছর ধরে শুটিং করেন। মুক্তি পেয়েছে গত বছর। মজা করে বললেন, ‘যদি আমার কাজের তালিকা দেখেন, তাহলে বুঝবেন আমার কোনো কাজই সহজে মুক্তি পায়নি। “সাহস” সিনেমা মুক্তির সময়ও সেন্সর নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হয়, পরে তো ছবিটি ওটিটিতে মুক্তি পায়। আমার মুক্তি পাওয়া কাজের চেয়ে মুক্তি না পাওয়া কাজের সংখ্যা নেহাত কম নয়! এ ছাড়া কয়েকটি কাজে শুটিংয়েও প্রচুর সময় লেগেছে। যেমন ফেউ-এর প্রস্তুতির জন্য আমাকে দেড় বছর সময় দিতে হয়েছে। আমার জন্য অপেক্ষা কঠিন নয়; বরং শেখার সময়।’
ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পূর্তিতে শাকিব খানকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে তাঁকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র। তখন দাঁড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন মোস্তাফিজুর। পুরোপুরি বাণিজ্যিক সিনেমার সঙ্গে আপাতদৃষ্টে তাঁর যোজন যোজন দূরত্ব। সামনে পেয়ে তাই তাঁর কাছে জানতে চাই, সেদিন তিনি এতটা উচ্ছ্বসিত ছিলেন কেন? বাণিজ্যিক সিনেমা নিয়ে তাঁর ভাবনা কী?
‘ফেউ’-এর দৃশ্যে মোস্তাফিজুর নূর ইমরানচরকি
‘প্রথমত, আমি কমার্শিয়াল সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম—এই দুটি জনরাকে ভাগই করতে চাই না। ফিল্ম ইজ ফিল্ম। ঋতুপর্ণ ঘোষের “আবহমান” সিনেমায় একটা সংলাপ আছে, “সিনেমায় মুহূর্তই সব”। যদি ব্যবসা করে, তাহলে হিট ছবি আর ব্যবসা না করলে ফ্লপ। কোনোটা ভালো ছবি, কোনটা খারাপ ছবি—এই তো। ছবিকে আলাদা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না,’ বললেন মোস্তাফিজুর। ‘রঙিলা কিতাব’-এ আততায়ীর চরিত্র করছেন; শাকিবের বিপরীতে খলনায়ক হওয়ার প্রস্তাব পেলে রাজি হবেন? চটপট উত্তর, ‘আমি একটা ব্যাপারই দেখব, গল্পটা কী আর চরিত্রটা কী। খলনায়ক যদি অ্যানাকোন্ডা না হয়, তাহলে তো জমবে না।’
‘রঙিলা কিতাব’-এ তাঁকে অ্যাকশন করতেও দেখা গেছে। জানালেন, শুটিংয়ের আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। বান্দরবানের প্রচণ্ড গরমে সীমিত কারিগরি সামর্থ্যের মধ্যে অ্যাকশন দৃশ্য ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। এমন একটা অ্যাকশন চরিত্রে প্রস্তাব পেয়ে নিজেই চমকে গিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক সিনেমার প্রসঙ্গ উঠতেই সিরিজটির উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি তো সব ধরনের কাজই করতে চাই, সে জন্যই তো নিজেকে প্রস্তুত করা। “সুপারহিরো সুপারহিরোইন” রিয়েলিটি শোতে আমাকে নাচ, অ্যাকশন—সবই করতে হয়েছে। পরে হয়তো এ ধরনের চরিত্রে এভাবে আমাকে কেউ ভাবেনি। আমাকে এ ধরনের অ্যাকশন দৃশ্য করানোর জন্য (“রঙিলা কিতাব”-এর নির্মাতা) অনমদার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফার আসিফ হাসানের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।’
‘গুলমোহর’ সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। চরকির সৌজন্যে
মোস্তাফিজুর নূর ইমরান পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্ণিল ক্যাম্পাস, বিচিত্র সব চরিত্র। ক্যাম্পাসের এসব চরিত্র অভিনয়ে কতটা কাজে আসে? ‘অনেক...আমি বলব জাহাঙ্গীরনগরে না পড়লে আমার জীবনের ১৪ আনাই বৃথা হতো। বাগেরহাটে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, আমার নাড়ি ওখানে। বাগেরহাটের পরেই আমি জাহাঙ্গীরনগরের কাছে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ। অনেক কিছু শিখেছি। জীবনের যে সময়গুলোতে আমি সবচেয়ে বেশি কর্মহীন থেকেছি, সেই সময়ের কাছেও আমি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ,’ এক নিশ্বাসে বলে গেলেন অভিনেতা।
ইদানীং বাণিজ্যিক সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে আসছেন প্রখ্যাত সব অভিনয়শিল্পী। সেটা ‘বরবাদ’-এর মামুনুর রশীদই হোন, আর ‘তাণ্ডব’-এর আফজাল হোসেন। এটাকে খুব ইতিবাচকভাবে দেখছেন মোস্তাফিজুর। তাঁর মতে, ভালো কাহিনি আর ভালো বাহিনী। ভালো কাহিনি ভালো বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত না এক হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো কাজ হবে না।
অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষা তাঁর স্ত্রী; একই পেশার আরেকজন যখন ঘরেই আছেন, দুজনের কি কাজ নিয়ে কথা হয়? আলাপ শেষ করতে করতে মোস্তাফিজুর বললেন, ‘অবশ্যই। চুলচেরা বিশ্লেষণ। দুজনই দুজনেরই উন্নতির জন্য সেসব কাজে লাগাই।’ যাওয়ার আগে বললেন, নতুন কয়েকটি কাজ আসছে, তবে বলতে মানা। কাজগুলো আসতে আরও সময় লাগবে। অপেক্ষায় যে তাঁর আপত্তি নেই, সে কথা তো বলেছেন আগেই।