নীলগাই আসছে নিয়মিত, কোনোটি মারা যায়, কোনোটি উদ্ধার হয় আহত অবস্থায়
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 13-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

গায়ের রং নীল না হলেও প্রাণীটির নাম নীলগাই। আবার মোটেও এটি গরু নয়, দেখতে বরং অনেকটা ঘোড়ার মতো। তবে এটি ঘোড়াও নয়। মায়াবী এই প্রাণীকে দূর থেকে দেখে কেউ গরু, কেউ ঘোড়া, কেউ–বা হরিণ ভাবেন। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ১৯৪০ সালের পর থেকে এ দেশের বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় প্রায়ই নীলগাইয়ের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। লোকালয়ে আসামাত্রই প্রাণীটির পিছু নেন লোকজন। এতে কোনোটি মারা যায়, কোনোটি উদ্ধার হয় আহত অবস্থায়।

সর্বশেষ গত রোববার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ী ইউনিয়নের সরকারপাড়া এলাকায় ভুট্টাখেতে একটি নীলগাই দেখে তাড়া করে ধরে ফেলেন স্থানীয় লোকজন। পরে বন বিভাগের কর্মীরা আহত অবস্থায় স্ত্রী নীলগাইটি উদ্ধার করে তাঁদের কার্যালয়ের রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে জেলায় এভাবে চারটি নীলগাই এসেছে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজনের তাড়া খেয়ে মারা গেছে একটি, স্বল্প সময় দেখা দিয়ে চলে গেছে একটি। স্থানীয় বাসিন্দারা তাড়া করে ধরেছেন দুটিকে।

 

বন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রাণীবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এ প্রাণীটি ভারত থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তবে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে বেশির ভাগ নীলগাই আহত হচ্ছে। খাবারের সন্ধানে বের হয়ে, দলছুট হয়ে কিংবা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এসব নীলগাই ছুটে আসছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

পঞ্চগড়ে গত রোববার উদ্ধার হওয়া আহত নীলগাইটি বন বিভাগের স্টাফ কোয়ার্টারের একটি কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে

পঞ্চগড়ে গত রোববার উদ্ধার হওয়া আহত নীলগাইটি বন বিভাগের স্টাফ কোয়ার্টারের একটি কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে

পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিলুপ্ত

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নীলগাই বাংলাদেশের প্রকৃতিতে একসময় ছিল। শত বছর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে প্রচুর নীলগাই দেখা যেত। কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ১৯৪০ সালের পর থেকে এ দেশের বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীটিকে আর দেখা যায়নি। তাই নীলগাইকে এ দেশে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

অ্যান্টিলোপ প্রজাতির মধ্যে নীলগাই হলো সবচেয়ে বড় প্রাণী। পুরুষ নীলগাইয়ের শিং থাকে। এদের গায়ের রং হয় কিছুটা কালচে। একই প্রজাতির স্ত্রীদের ক্ষেত্রে শিং থাকে না। স্ত্রী প্রজাতির নীলগাইয়ের রং হয় কিছুটা বাদামি। নারী নীলগাই প্রাপ্তবয়স্ক হয় দুই বছরে। আর পুরুষ প্রজাতি প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় নেয় পাঁচ বছর। এরা একসঙ্গে একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর থেকে এদের নিরাপত্তা ‍ও দেখভালের পুরো দায়িত্ব পালন করে মা নীলগাই।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো. শরীফ হোসেন বলেন, ‘নীলগাই আমাদের দেশের বিলুপ্ত প্রাণী। কিন্তু কোনো কারণে এ প্রাণীটি দেশে প্রবেশ করলে সেটি জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করবে। নীলগাই সাধারণত মানুষ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। এ জন্য এগুলো উপকূলীয় বনাঞ্চলে বসবাস করে। এসব প্রাণী মূলত খাদ্যাভ্যাসের কারণে, বিরূপ পরিবেশের কারণে, হঠাৎ দলছুট হয়ে বা প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসে। এসব বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সরকারের সহায়তায় বন বিভাগ কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা উচিত।’

 

পঞ্চগড় সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে মাঝেমধ্যেই নীলগাইসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী ধরা পড়ে। কিন্তু বন বিভাগে বন্য প্রাণী উদ্ধার বা সংরক্ষণের জন্য আলাদা কোনো কর্মকর্তা নেই।

হরিপদ দেবনাথ, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পঞ্চগড় সামাজিক বনায়ন ও নার্সারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের রাজস্থান, উত্তরাখন্ড, তামিলনাড়ু, কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার বিশাল বনভূমিতে নীলগাইয়ের অবাধ বিচরণ রয়েছে। সেসব স্থান থেকেই এসব নীলগাই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোয় নীলগাই বিচরণের জন্য তেমন অনুকূল পরিবেশ না থাকায় সেগুলো লোকালয়ে চলে আসছে এবং বিভিন্ন ফসলের খেতে আশ্রয় নিচ্ছে।

৭ বছরে এসেছে ৯ নীলগাই

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রোববার পর্যন্ত পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ৯টি নীলগাইয়ের দেখা পাওয়া যায়। এগুলোর বেশির ভাগ বিভিন্ন সাফারি পার্কে পাঠানো হয়েছে। কোনোটি আবার জনতার হাতে মারা পড়েছে।

পুরুষ নীলগাইয়ের শিং থাকে, গায়ের রং হয় কিছুটা কালচে।  স্ত্রীদের ক্ষেত্রে রং হয় কিছুটা বাদামি। গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত সাফারি পার্কের কোর সাফারিতে

পুরুষ নীলগাইয়ের শিং থাকে, গায়ের রং হয় কিছুটা কালচে। স্ত্রীদের ক্ষেত্রে রং হয় কিছুটা বাদামি। গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত সাফারি পার্কের কোর সাফারিতে

গত ৯ এপ্রিল পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা পূর্ব জয়ধরভাঙ্গা এলাকায় তাড়া করে আহত অবস্থায় একটি স্ত্রী নীলগাই ধ\রেন গ্রামবাসী। পরে বিজিবির সহায়তায় বন বিভাগের কর্মীরা নীলগাইটি উদ্ধার করে চিকিৎসা দেন। তিন দিন পর ওই নীলগাইটি কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পাঠানো হয়। এর আগে ২০২৩ সালের ২১ মে জেলার আটোয়ারী উপজেলায় একটি ভুট্টাখেতে একটি নীলগাই দেখা দিলেও সেটি ধরতে পারেননি স্থানীয় লোকজন। পরে নীলগাইটি সেখান থেকে চলে যায়। এ ছাড়া ২০২১ সালের ১৭ মার্চ আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর এলাকায় গ্রামবাসীর কাছে তাড়া খেয়ে একটি নীলগাই মারা যায়।

 

এদিকে পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মোট পাঁচটি নীলগাই পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে রানীশংকৈল উপজেলায় একটি নীলগাই স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়া খেয়ে মারা গিয়েছিল। অন্য একটি নীলগাইকে জবাই করেছিলেন স্থানীয় লোকজন। অন্য তিনটি নীলগাই আহত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ও বিভিন্ন সময় নীলগাই উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে।

 

রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে গত কয়েক বছরে গাজীপুর সাফারি পার্কে অন্তত পাঁচটি নীলগাই পাঠানা হয়েছে। সেখানে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১২টিতে দাঁড়িয়েছে। এদিকে গত ৯ এপ্রিল পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়া স্ত্রী নীলগাইটির সঙ্গী হিসেবে গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে একটি পুরুষ নীলগাই নিয়ে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ রোববার পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়া নীলগাইটিকেও ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

রক্ষায় প্রয়োজন জনসচেতনতা

বিভিন্ন সময় লোকালয়ে আসা নীলগাইকে সচেতনতার অভাবে অনেকেই তাড়া করছেন। এর জন্য সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করার প্রয়োজনের কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে দক্ষ জনবল না থাকায় লোকালয়ে আসা নীলগাই উদ্ধার করতে সমস্যায় পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা।

পঞ্চগড় সামাজিক বনায়ন ও নার্সারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরিপদ দেবনাথ বলেন, পঞ্চগড় সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে মাঝেমধ্যেই নীলগাইসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী ধরা পড়ে। কিন্তু বন বিভাগে বন্য প্রাণী উদ্ধার বা সংরক্ষণের জন্য আলাদা কোনো কর্মকর্তা নেই। এমনকি এখানে কর্মরতদের কারও সে রকম কোনো প্রশিক্ষণও নেই। কোনো বন্য প্রাণী রাখার পৃথক কক্ষ বা খাঁচাও নাই। এ জন্য পঞ্চগড়ে বন্য প্রাণী উদ্ধার ও সংরক্ষণেরে জন্য জনবল খুবই প্রয়োজন।

রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্য প্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে যেসব নীলগাই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এগুলোকে যদি সাফারি পার্কে সংরক্ষণ করে বংশবিস্তার করানো যায় তাহলে বাংলাদেশে প্রকৃতিতে আবারও নীলগাই ফিরে আসবে। এ জন্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন এ ধরনের প্রাণী দেখলে তার পিছু নিয়ে তাড়া করা বা বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ, এ ধরনের বন্য প্রাণী হত্যা করা বাংলাদেশের আইনেও দণ্ডনীয় অপরাধ।

শেয়ার করুন