নেটিজেনরা ‘ধুয়ে দিচ্ছে’ পরিবারকে, বাস্তবতা ভিন্ন
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 17-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

স্টেশনে দুই রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন পেঁয়াজচাষি মীর রুহুল আমিন (৭০) নামের এক ব্যক্তি। ট্রেন আসামাত্রই তিনি লাইনে শুয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। গত সোমবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী রেলস্টেশনে এ ঘটনা ঘটে।

মীর রুহুল আমিনের আত্মহত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। আত্মহত্যা নিয়ে নেটিজেনরা ধুয়ে দিচ্ছেন তাঁর পরিবারকে। তাঁরা লিখছেন, পরিবারের অবহেলার শিকার হয়েছে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন ঘটনা।

মীর রুহুল আমিনের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মাঝপাড়া বাউসা গ্রামে। আড়ানী রেলস্টেশনে ঢাকাফেরত ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়ে তাঁর আত্মহত্যার সময় কয়েকজন তরুণ টিকটক করছিলেন। তাঁদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে তাঁর আত্মহত্যার দৃশ্য। এতে দেখা যায়, স্টেশনে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটি ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। ট্রেন কাছে আসামাত্রই মীর রুহুল আমিন লাইনের ওপরে শুয়ে পড়েন। ট্রেনের চাকা তাঁর দেহকে দুই ভাগ করে দিয়ে যায়।

মীর রুহুল আমিন

মীর রুহুল আমিন

 

 

এ নিয়ে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘ওই বৃদ্ধের স্ত্রী আট মাস আগে মারা যান। এরপর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে কিছুদিন বাবাকে রাখার পর আর রাখতে চাননি। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া। এমনও রাত গেছে, বৃদ্ধ সারা রাত উঠানে ছিল, ছেলেরা দরজা খোলেনি। মৃত্যুর দিন সকালে দুই ছেলের বউয়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয় এবং তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে ছেলেরা তাঁর জিনিসপত্র উঠানে ফেলে দেন। এরপর স্টেশনে ভোর থেকে বসেছিল। কিছু খাননি দুপুর পর্যন্ত। এরপর আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।’

এক ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

এক ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

মো. নাসির হায়দার রানা নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে ছবিসহ একই রকম পোস্ট দেন। মো. রায়হান আলী নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারীও একই লেখা ব্যবহার করেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত করেন নিজের আবেগময় লেখা। একই লেখার সঙ্গে নিজ নিজ আবেগময় বক্তব্য যোগ করে মো. আল আমিন পাটোয়ারীসহ অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট দেন। এসব পোস্টে তাঁদের বন্ধু–অনুসারীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আবদুস সামাদ মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। পাশাপাশি আল আমিন পাটোয়ারীর পোস্টের মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘সন্তানদের বিচার চায় মানুষ।’

 

কিন্তু মীর রুহুল আমিনের বাড়িতে গিয়ে জানা যায় ভিন্ন ঘটনা। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেঁচে আছেন। ফেসবুকে নিজের মারা যাওয়ার খবর দেখে তিনি হতভম্ব। ফেসবুকে বলা হচ্ছে, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বাস্তবে তাঁদের দুটি সন্তান, এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের ২০-২২ বছর আগে বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি ঈশ্বরদীতে। ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে স্বল্প বেতনের চাকরি করেন, থাকেন সেখানেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মীর রুহুল আমিনের খুবই ভালো সম্পর্ক। গ্রামের বাড়িতে শুধু মা–বাবা থাকেন। ফেসবুকের এই কল্পকাহিনি দেখে তাঁরা পরিবারের সদস্যরা যারপরনাই বিব্রত।

আজ বুধবার সকালে মীর রুহুল আমিনের স্ত্রী মরিয়মের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর কোমরের সমস্যা ছিল, একটু কাত হয়ে হাঁটতেন। ঘটনার দিন সকালে খাওয়াদাওয়ার পরে তিনি চিকিৎসক দেখাতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। বেলা তিনটার আগে ও পরে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে দুবার কথা হয়েছে। শেষবার তিনি বলেছেন, কাল পেঁয়াজ তুলতে হবে। আকাশে মেঘ করছে। পলিথিন আনতে হবে। মীর রুহুল আমিন স্ত্রীকে আরও বলেছেন, তিনি আড়ানীতে এসেছেন। পলিথিনি নিয়ে আসছেন। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য কাঁচাবাজার লাগবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।

মেয়ে মৌসুমী আক্তার বলেন, ঘটনার দিন সকাল ৮টা ৪২ মিনিটে বাবা তাঁকে ফোন করে বলেছেন, ‘কাল পেঁয়াজ উঠাতে হবি। তোমার মায়ের অনেক ঝামেলা হবি। তাড়াতাড়ি আইসো।’ মৌসুমী আরও জানান, পয়লা বৈশাখের ছুটির দিনে ডাক্তার পাওয়া যাবে না। তাই বাবাকে ডাক্তার দেখাতে যেতে মানা করেছিলেন তিনি।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মাঝপাড়া বাউসা গ্রামে মীর রুহুল আমিনের বাড়ি

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মাঝপাড়া বাউসা গ্রামে মীর রুহুল আমিনের বাড়ি

একমাত্র ছেলের বউ শোভা খাতুন জানান, পেঁয়াজ ওঠানোর কাজের জন্য সকাল আটটার দিকে তাঁর শ্বশুর তাঁকে বাড়িতে আসার জন্য ফোন করেছিলেন।

কোনো ঋণ আছে কি না, জানতে চাইলে ছেলে মীর রনী বলেন, পেঁয়াজ চাষের জন্য তাঁর বাবা বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ করেছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় তিনটি বেসরকারি সংস্থা থেকে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ৬৪ হাজার ও ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন মীর রুহুল আমিন। প্রতি সপ্তাহে তাঁকে ৪ হাজার ৪৫০ টাকা কিস্তি দিতে হতো। এখনো ৯৯ হাজার ২৯০ টাকা ঋণ অবশিষ্ট রয়েছে।

মীর রুহুল আমিনের ভাতিজা মীর মোফাক্কর হোসেন বলেন, জমি বর্গা নিয়ে ১ বিঘা ৫ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন তাঁর চাচা। এ জন্য ঋণ করেছিলেন। ওই ঋণের কিস্তি চালানোর জন্য স্থানীয় আড়তদার ও মহাজনের কাছ থেকেও হয়তো ঋণ করেছিলেন। পেঁয়াজের দাম কম। তাই ঋণ শোধ করার দুশ্চিন্তায় তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে তাঁর ধারণা।

ঈশ্বরদী জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খোঁজ নিয়ে তাঁরা জানতে পেরেছেন মীর রুহুল আমিন এনজিও থেকে ঋণ করে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়নি। এ নিয়ে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। কারও সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেননি। শারীরিকভাবে একটু অসুস্থও ছিলেন। এ সব কারণে তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 

 

শেয়ার করুন