খেলোয়াড়েরা তো বটেই, স্বাস্থ্যসচেতন তরুণ-তরুণীদেরও প্রিয় পানীয় হয়ে উঠেছে আজকাল ইলেকট্রোলাইটস ড্রিংক। পাশাপাশি টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের নানা রকম কনটেন্ট ইলেকট্রোলাইটস পানীয়র চাহিদা বাড়িয়ে চলেছে। বাজারেও সহজে মিলছে এই সুপার-হাইড্রেটিং মিনারেল। বিদেশ থেকে আমদানি করে বাজারজাত করা হচ্ছে, আবার বাংলাদেশেও অনেক প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রোলাইটস পানীয় তৈরি ও বাজারজাত করছে। অনুমোদন না নিয়ে ইলেকট্রোলাইটস ড্রিংক উৎপাদন করে বাজারে ছাড়ায় পাঁচটি পানীয় তৈরির প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ বছর মামলাও হয়েছে। এত কিছুর পরও দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এই পানীয়। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে অসহনীয় গরমের কারণে এমন পানীয় খাওয়ার চল বেড়েছে। আসলেই কি ফিটনেস ও স্বাস্থ্যের জন্য ইলেকট্রোলাইটস পানীয় উপকারী? স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে আসলেই কি বাড়তি ইলেকট্রোলাইটস পানীয় প্রয়োজন?
ইলেকট্রোলাইটস আমাদের দেহেই থাকে। নিয়মিত আমরা যা খাই ও পান করি, সেসবের মধ্য দিয়ে এগুলো শরীরে প্রবেশ করে। তবে পেট খারাপ বা ব্যায়ামের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে অনেক সময় ইলেকট্রোলাইটস কমে যায়। ব্যায়ামের সময় আপনি অবশ্যই ঘামাবেন। বাইরে রোদ–গরম থেকে ফিরলেও ঘামেন বেশির ভাগ মানুষ। ঘাম শুকিয়ে গেলে গাঢ় রঙের টি-শার্টে কিছু সাদা দাগ দেখা যায়, সহজভাবে এগুলোই ইলেকট্রোলাইটস। ইলেকট্রোলাইটস এমন খনিজ, যা নির্দিষ্ট তরলে দ্রবীভূত হয়ে বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। মানবদেহে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফেটের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেহ নিজস্ব জৈবিক প্রক্রিয়া বাইকার্বোনেট তৈরি করে। আমরা যা খাই, তার থেকেই ফসফেট ও ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে পারি। খাবারের সময় যে লবণ খাই, তার থেকে আসে সোডিয়াম ক্লোরাইড। ইলেকট্রোলাইটস পানীয়তে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আর সোডিয়াম থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির পুষ্টি ও ডায়েটিকসের সহযোগী অধ্যাপক নাটালি অ্যালেন বলেন, ইলেকট্রোলাইটস শরীরের অনেক কাজের জন্য অপরিহার্য। শরীরের তরল স্তর বজায় রাখতে সহায়তা করে। হৃদ্যন্ত্র আর স্নায়ু ফাংশনকে সাহায্য করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পেশি ও স্নায়ুর কার্যকারিতা থেকে শুরু করে হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে ম্যাগনেসিয়াম। ক্লোরাইড তরলে ভারসাম্য ও হজমে সহায়তা করে। পটাশিয়াম আপনার হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করতে, রক্তচাপ কমাতে ও কিডনির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। পেশির স্বাভাবিক সংকোচনের জন্যও প্রয়োজন হয় ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম। ইলেকট্রোলাইটসের অভাবে দ্রুত বিভিন্ন কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে পারে আপনার শরীর।
অনেক কারণে শরীরে ইলেকট্রোলাইটসের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। মডেল: আয়েশা ও সৌরভ অভিছবি: কবির হোসেন
নানা কারণে আমাদের শরীর থেকে ইলেকট্রোলাইটস কমে যায়। শরীরের তরলের মাত্রা কমে গেলে ইলেকট্রোলাইটসও কমে যায়। অসুস্থতা বা ডায়রিয়ার কারণে কমে যেতে পারে ইলেকট্রোলাইটস। শরীরের অন্ত্রে সিবো নামের ব্যাকটেরিয়া অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে ইলেকট্রোলাইটসের প্রয়োজনীয় খনিজের অভাব দেখা যায়। কেউ যদি প্রচুর অ্যালকোহল পান করেন, তিনি পানিশূন্যতার ঝুঁকিতে থাকবেন। এতে শরীরে ইলেকট্রোলাইটসের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। অফিসে কঠিন চাপে থাকলে অনেকে কাপের পর কাপ কফি খেতে থাকেন, এর প্রভাব শরীরের ইলেকট্রোলাইটস স্তরে পড়ে। তখন প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেশি বেশি খনিজ পদার্থ বের হয়ে যায়। আপনি শরীর থেকে কতটা তরল হারাচ্ছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ঘামেন, সেটা বাস্তব ও স্বাভাবিক বিষয়। যদি গরম বা আর্দ্র অবস্থায় ম্যারাথনে দৌড়ান, তখন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করলে হাইপোনেট্রেমিয়া বা সোডিয়াম কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। জিম করার সময় নিয়মিত পানি পান করলে এমন বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। যদি আপনি অস্বাভাবিকভাবে ঘামেন আর আপনার পোশাকটি শুকিয়ে গেলে কিছু সাদা দাগ তৈরি করে, তাহলে বলা যায় আপনি আসলে অনেক ইলেকট্রোলাইটস হারাচ্ছেন। ওজন ও শরীরের গঠনেও ইলেকট্রোলাইটস ভূমিকা রাখে। মানুষের পেশি চর্বির চেয়ে বেশি পানি সঞ্চয় করে। কারও কম চর্বি ও বেশি পেশি থাকলে তার শরীরে ওজন হয় বেশি। কম পেশি বহনকারী ব্যক্তির তুলনায় তাদের শরীরে পানির পরিমাণ বেশি থাকবে। তখন ইলেকট্রোলাইটস পানীয় আপনাকে সারা দিন হাইড্রেটেড থাকতে সাহায্য করতে পারে।
অনুমোদনহীন ইলেকট্রোলাইটস পানীয় খাওয়া ঠিক নয়ছবি: কবির হোসেন
ইলেকট্রোলাইটস গ্রহণ নিয়ে আদৌ চিন্তা করা ঠিক হবে কি না, এটাও একটা প্রশ্ন। ইলেকট্রোলাইটস পানীয়তে বেশ খানিকটা সোডিয়াম ও চিনি থাকে। এসব কম খরচে সহজেই পাওয়া যায়। পুষ্টিবিদদের মতে, যদি নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করেন, তাহলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত খাবার, উচ্চ মানের প্রোটিনসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এভাবে প্রতিদিনের খাবার থেকেই ইলেকট্রোলাইটসের চাহিদা মেটানো যায়। কিছু খাবার আছে, যা প্রাকৃতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে শরীরে ইলেকট্রোলাইটস সরবরাহ করে। যেমন পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের একটি দুর্দান্ত উত্স দই। সবুজ শাকসবজি, বাদাম, বীজ, ডার্ক চকলেট এবং দানাদার শস্য ম্যাগনেসিয়ামের চমৎকার উৎস। অন্যদিকে কলা, অ্যাভোকাডো ও ডাবের পানি আপনাকে পটাশিয়াম বাড়াতে সাহায্য করবে। ট্যাপের পানিতে সাধারণত অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম থাকে। কিছু ব্র্যান্ডের বোতল বা প্যাকেটজাত পানীয়তে যথেষ্ট ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আর পটাশিয়াম থাকে। এসব আপনার দৈনন্দিন প্রয়োজনও মেটাতে পারে। তবে যাঁরা ডায়েট করেন, তাঁরা পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শমতো এই পানীয় খেতে পারেন। অনুমোদনহীন ইলেকট্রোলাইটস পানীয় খাওয়া ঠিক নয়। কোন কোন প্রতিষ্ঠান নিজেদের পানীয়তে ইলেকট্রোলাইটস বেশি আছে বলে দাবি করে। অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সোডিয়াম ও চিনি খান, তাঁরা ইলেকট্রোলাইটস পানীয় পান করলে বরং পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
যদি প্রতিদিন ফল, বাদাম, শাক ও প্রোটিন খান, সঙ্গে ঠিকমতো পানি খান তাহলে আপনার আলাদা করে ইলেকট্রোলাইটস সম্পর্কে চিন্তার দরকার নেই। তবে আপনি যদি প্রচুর ঘামেন, চাপে থাকেন, কাজে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়, তাহলে ইলেকট্রোলাইটস পানীয় পান করতে পারেন।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান