হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে গত শুক্রবারের বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স।
এ ঘটনা দেখিয়ে দিল, ভ্যান্স তাঁর কিছু পূর্বসূরির মতো নিজেকে রাজনৈতিক ছায়াখেলোয়াড়ের মতো লুকিয়ে রাখেন না। তিনি খোলা মঞ্চে আক্রমণকারীর ভূমিকা নিতে মোটেও ভয় পান না।
হোয়াইট হাউসের বৈঠকে জেলেনস্কির ওপর আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভ্যান্স। এরপর আক্রমণে যোগ দেন ট্রাম্প।
বৈঠকটি ততক্ষণ সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল, যতক্ষণ ভ্যান্স ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশংসার প্রসঙ্গ তোলেন।
জবাবে জেলেনস্কি বলেন, ‘জে ডি (ভ্যান্স), কী ধরনের কূটনীতির কথা আপনি বলছেন?’
ওয়াশিংটন-মস্কোর মধ্যে সরাসরি আলোচনার সমালোচক জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘আপনি কী বলতে চান?’
জবাবে ইউক্রেনীয় নেতাকে কড়াভাবে ভ্যান্স বলেন, ‘আমি এমন কূটনীতির কথা বলছি, যা আপনার দেশকে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চলছে।’
ভ্যান্স আরও বলেন, ‘জনাব প্রেসিডেন্ট, আপনাকে মান্য করেই বলছি, আমি মনে করি, ওভাল অফিসে ঢুকে মার্কিন গণমাধ্যমের সামনে এই বাহাসের চেষ্টা সম্মানজনক নয়।’
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে প্রচার চালানোর অভিযোগও জেলেনস্কির বিরুদ্ধে আনেন ভ্যান্স।
নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য পেনসিলভানিয়ার একটি অস্ত্র কারখানা গত সেপ্টেম্বরে পরিদর্শন করেছিলেন ইউক্রেনীয় নেতা। তখন তিনি হোয়াইট হাউসে গিয়ে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
জেলেনস্কির প্রতি ভ্যান্সের ভর্ৎসনা রিপাবলিকানদের ব্যাপক সমর্থন কুড়িয়েছে। সাউথ ক্যারোলাইনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, ‘আমাদের দেশের পক্ষে জে ডি ভ্যান্স দাঁড়ানোয় আমি খুবই গর্বিত।’
জেলেনস্কির পদত্যাগ করা উচিত বলেও পরামর্শ দেন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম।
আলাবামার সিনেটর টমি টিউবারভিল জেলেনস্কির কথা বলতে গিয়ে তাঁকে ‘ইউক্রেনীয় বেজি’ বলে উল্লেখ করেন।
নিউইয়র্কের কংগ্রেসম্যান মাইক ললার এ বৈঠককে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন উভয়ের জন্য হারিয়ে ফেলা একটি সুযোগ বলে অভিহিত করেন।
সফররত একজন রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর ভ্যান্স যে আক্রমণটা করলেন, একজন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট সচরাচর তেমনটা করেন না।
কেউ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থাকেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর রানিংমেট। রানিংমেট হিসেবে তাঁর কাজ প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী করতে সাহায্য করা। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর কাজ হয় প্রেসিডেন্টের পাশে চুপচাপ বসে থাকা।
বিদেশ সফরে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্টের একজন অনুগত ব্যক্তি হিসেবেই সব কাজ করেন, বলেন।
ট্রাম্পের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাইক পেন্স। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি অনেক বেশি মৃদু স্বভাবের ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ভ্যান্সের বৈপরীত্য ব্যাপক।
ভ্যান্স দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তার বিষয়ে খোলামেলাভাবে সংশয় প্রকাশ করে আসছেন।
২০২২ সালে ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও থেকে সিনেটর হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখন তিনি একটি পডকাস্টে বলেছিলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে কী ঘটছে, তা নিয়ে তিনি সত্যিই চিন্তা করেন না।
আট বছর আগে ট্রাম্পকে একজন ‘হাঁদারাম’ বলে উপহাস করেছিলেন ভ্যান্স। পরে সেই তিনিই ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ আন্দোলনের উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠেন।
রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে ভ্যান্সের জনপ্রিয়তা আছে। তবে ট্রাম্প সম্প্রতি ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০২৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে ভ্যান্স তাঁর উত্তরসূরি হবেন কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ট্রাম্পের এমন কথা সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে ভ্যান্স রাজনৈতিক ঝগড়াবাজের ভূমিকা পালন করছেন বলে মনে হচ্ছে। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের শত্রুদের স্পষ্ট সমালোচনায় তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়েও এগিয়ে যাচ্ছেন।
একটি সাধারণ বিষয় হলো, ভ্যান্সের আক্রমণের অনেক শিকারই আমেরিকার মিত্র। এই আক্রমণের সূত্রপাত হয়েছিল গত মাসে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে। সেখানে তিনি ইউরোপীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক ঝাল ঝাড়েন।
ভ্যান্সের ভূমিকা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন উঠছে। যেমন হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির ওপর ভ্যান্সের তীব্র আক্রমণ কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল?
কূটনীতিকেরা তেমনটাই বিশ্বাস করেন। তবে হোয়াইট হাউসের একাধিক সূত্র মার্কিন সংবাদমাধ্যমে বলেছে, আক্রমণ পূর্বপরিকল্পিত ছিল না।
আরও যেসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো ভ্যান্সের নতুন ভূমিকা কি ট্রাম্পের নির্দেশেই আবির্ভূত হচ্ছে?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরোধীদের শায়েস্তা করার কাজ ইলন মাস্কের সঙ্গে কি ভ্যান্স ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন?
নাকি ভ্যান্স স্বাধীনভাবে এই কাজ করছেন, যা তাঁকে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার করার ভিত্তি তৈরি করে দেবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর যা-ই হোক না কেন, ট্রাম্প প্রশাসনের দুই নম্বর ব্যক্তির চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠছেন ভ্যান্স।