রাশিয়ায় দুই দিনের দ্বিপক্ষীয় সফর করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করাই এ সফরের মূল লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে মোদির এই রাশিয়া সফর ভালো চোখে দেখছে না পশ্চিমারা। তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথম বিদেশসফর হিসেবে তিনি বেছে নিলেন রাশিয়াকেই; কিন্তু কেন? এর পেছনে রয়েছে দুই দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মোদি ও রাশিয়ার পুতিনের মধ্যে অস্ত্র আলোচনার পেছনে কী রয়েছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটু পেছনে ফিরতে হবে। প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা অনেক পুরোনো। ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে রাশিয়া। তবে মোদির এবারের রাশিয়া সফরে দুই দেশের মধ্যে নতুন কোন অস্ত্র চুক্তি হয়েছে, তার বিস্তারিত এখনো সামনে আসেনি। এটা সহজেই বোঝা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে রসদ হিসেবে রাশিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন। মোদি রাশিয়াকে দেশটির শিল্প খাতের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন। এর বিনিময়ে তিনি জ্বালানি ও সামরিক প্রযুক্তি নিতে পারেন। রাশিয়াকে ভারত সমর্থন দিতে পারে। বিষয়টি বাস্তবসম্মত। তবে রাশিয়ার যুদ্ধচেষ্টাকে ভারত প্রকাশ্যে সমর্থন করার পথে পা বাড়াবে না।
গত দশক থেকেই নিজস্ব সামরিক-শিল্পকারখানা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে ভারত। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের বলছে, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ তাদের অগ্রাধিকার। এ ছাড়া রাশিয়া বা অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে চুক্তিতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেয় ভারত; কিন্তু ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সাঁজোয়া ডিভিশন এখনো রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। তাদের ৩ হাজার ৭৪০টি ট্যাংকের ৯৭ শতাংশ রাশিয়ার তৈরি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ক্রয় বহুমুখী করার চেষ্টা করছে। তবে রুশ কোম্পানিগুলো এখনো ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠতে সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে। মোদির মস্কো সফরের আগে রুশ রাষ্ট্রীয় রপ্তানি প্রতিষ্ঠান রসটেক টি-৯০ ট্যাংকের জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার উদাহরণ হিসেবে, ব্রাহমোস সুপারসনিক অ্যান্টিশিপ ক্ষেপণাস্ত্রটির কথা তুলে ধরা যায়। এটি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যৌথভাবে ভারতীয় ও রুশ প্রকৌশলীরা নকশা করেছিলেন এবং তা ২০০১ সালে প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল। ব্রাহমোস মূলত ব্রহ্মপুত্র নদ ও মস্কোভা নদীর নাম থেকে এসেছে। এটি দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে। এই ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিশালী ও দ্রুতগতির। এটি শব্দের তিন গুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারে এবং ওয়্যারহেডে ৩০০ কেজি পর্যন্ত ভর বহন করতে পারে। এ ছাড়া এ ক্ষেপণাস্ত্র অনেকটাই নিখুঁতভাবে লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।
রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে সেনাবাহিনীর জন্য ৩৫ হাজার কালাশনিকভ একে-২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরি করেছে ভারত। এর বাইরে সুখোই-৩০ এমকেআই চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটার জেট তৈরি ও মিগ-২৯-এর রক্ষণাবেক্ষণেও দুই দেশ একত্রে কাজ করে। এর বাইরে দুই দেশ কনক্রাস অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল তৈরিতেও কাজ করেছে।
রাশিয়া থেকে স্বল্পমূল্যে এক বছর ধরে জ্বালানি কিনছে ভারত। এটাই ভারতের অর্থনীতিকে এগিয়ে দিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে স্বল্পমূল্যে পেট্রোলিয়াম বিক্রির বিষয়টি। মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় ভারতের এবারের তালিকায় পারমাণবিক জ্বালানির বিষয়টিও থাকছে। ভারতের বেশ কিছু পারমাণবিক চুল্লি রাশিয়ার তৈরি। এর বাইরে ভারতের জন্য রুশ ভাসমান ও সামুদ্রিক পারমাণবিক চুল্লি—উভয়ই কেনার জন্য আলোচনা চলছে, যা দূরবর্তী অঞ্চলের জন্য উপযোগী হতে পারে। এর বাইরে সাবমেরিন ও বড় আকারের দীর্ঘপাল্লার নৌযানগুলোর জন্যও উপযোগী হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র কোথায় পাবে রাশিয়া? এরও উত্তর সহজ। রাশিয়া এর জন্য মিত্রদেশগুলোর দিকে হাত বাড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে উত্তর কোরিয়া সফর করেছেন পুতিন। দেশটির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিও করেছেন তিনি। ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য মস্কোর সশস্ত্র বাহিনীর ক্রমাগত কামান ও সব ধরনের ট্যাংক-গোলাবারুদের চাহিদা পূরণ করতে মরিয়া।
রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী প্রতিদিন আট হাজার গুলি করে, যার প্রতিটির দাম গড়ে চার হাজার ডলার। ইউক্রেন যুদ্ধে জিততে প্রতিদিন গড়ে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে ৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করছে। ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি এখন যুদ্ধকালীন অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে। এ জন্য পুতিনকে উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। দুটি দেশই রাশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই দেশকেই এখন নতুন সহযোগী খুঁজতে হচ্ছে, যাতে স্থবির যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়ে তারা সামনে এগোতে পারে। রাশিয়া আশা করছে, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনামের পাশাপাশি ভারতের শিল্প খাত তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিতে পারবে, যাতে তারা ইউক্রেনকে হারাতে পারে।