এত টালবাহানা শেষে একেবারে শেষবেলায় আমেথি ও রায়বেরিলি নিয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল—রাজনৈতিক সচেতন জনতা তো বটেই, কংগ্রেসের মধ্যেও তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কেউ কেউ মনে করছেন, এ ছাড়া উপায় ছিল না। কারও কারও ধারণা, এতে প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপিরই সুবিধা হয়ে গেল।
যদিও সেই বিতর্ক ছাপিয়ে এখন বড় হয়ে উঠছে এই প্রশ্ন, ওয়েনাড ও রায়বেরিলি—দুই আসনেই রাহুল জিতলে কোনটা রেখে কোনটা তিনি ছাড়বেন?
নতুন আলোচনা শুরু এই প্রশ্ন ঘিরেই।
গত লোকসভা নির্বাচনে আমেথিতে বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে রাহুল হেরেছিলেন ৫০ হাজার ভোটে। অপ্রত্যাশিত কিছু হতে পারে আঁচ করেই তিনি দ্বিতীয় আসন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কেরালার ওয়েনাড। তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কম আক্রমণাত্মক হননি। মুসলিম–অধ্যুষিত ওয়েনাড পছন্দ করার জন্য রাহুলকে কটাক্ষ করে তিনি প্রচারে বলেছিলেন, ওই অঞ্চলে গেলে বোঝা দুষ্কর সেটা ভারত না পাকিস্তান! তাতে রাহুলের জিততে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সেই থেকে বিজেপি প্রচার শুরু করে দেয়, আমেথিতে কংগ্রেসের খাসতালুক হাতছাড়া হয়ে গেছে। স্মৃতি ইরানি এবারও বারবার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, সাহস থাকলে রাহুল তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হোন। তিনি বুঝিয়ে দেবেন কত ধানে কত চাল।
অথচ রাহুল সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন না। রহস্য ধরে রেখে একেবারে শেষ বেলায় দ্বিতীয় আসন হিসেবে তিনি বেছে নিলেন রায়বেরিলি। আমেথিতে প্রার্থী করা হলো গান্ধী পরিবারের গত ৪০ বছরের নির্বাচনী ম্যানেজার কিশোরীলাল শর্মাকে।
বিভিন্ন জনমত সমীক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মনে করেন, এবার আমেথি থেকে মুখ ঘোরানো রাহুলের উচিত হয়নি। গত পাঁচ বছরে ইরানির প্রতি আমেথির বহু মানুষ নানা কারণে ক্ষুব্ধ। যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ২০১৯ সালে রাহুলকে হারিয়ে জিতেছিলেন, তার কিছুই প্রায় রক্ষা করতে পারেননি। যেমন বলেছিলেন, জিতলে ১৩ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। চিনির দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা। বলেছিলেন, পেট্রল-ডিজেলের দাম কমে যাবে। পেট্রল এক শ পার, ডিজেল এক শ ছুঁই ছুঁই। হাসপাতালের হাল ফেরানোর কথা বলেছিলেন। শিল্প স্থাপনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিছুই নাকি হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’ নাকি বহুগুণ বেড়ে গেছে। ছেড়ে দেওয়া বুড়ো গরু-মহিষ এলাকার ফসলের ক্ষতি করছে। চাষিরা বিপন্ন বোধ করছেন। অথচ ইরানি নাকি নির্বিকার। ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিক বিরোধিতার যে প্রবণতা দেখা যায়, ইরানির বিরুদ্ধে তা বেশ প্রবল। পাশাপাশি এই বিশ্লেষকদের ধারণা, এলাকার মানুষের যে অভিমানের দরুন রাহুলকে সেবার হারতে হয়েছিল, পাঁচ বছর পর তা উধাও। মানুষ মনে করছেন, সংসদ সদস্য হিসেবে রাহুলের মধ্যে একটা আন্তরিক চেষ্টা ছিল। অনেক কিছু চেষ্টা করেও তিনি পারেননি। ইরানির মধ্যে সেই আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। রাহুল প্রার্থী হলে এবার আমেথির জনতা অভিমান ভুলে তাঁকে ভোট দিতেন।
বস্তুত রাহুলকে প্রার্থী দেখতে আমেথির মানুষজন বহু দরবার করেছেন। বহুবার দাবি জানিয়েছেন। এমন একটা বিশ্বাস তাঁদের মনে জমা হয়েছিল যে শেষ বেলায় রাহুল ঠিকই আমেথিতে স্মৃতি ইরানির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। তা না হওয়ায় অবশ্যই তাঁরা হতাশ। এতে ইরানিরই সুবিধা হবে।
কংগ্রেস নেতা-কর্মী সমর্থকেরা একই রকম হতাশ প্রিয়াঙ্কার সিদ্ধান্তেও। তাঁদেরও ধারণা ছিল, রায়বেরিলিতে মা সোনিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসনে প্রিয়াঙ্কাই বসবেন।
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক নেতা এই প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেছেন, আমেথিতে রাহুল ও রায়বেরিলিতে প্রিয়াঙ্কা—এটাই ছিল দলের অধিকাংশের দাবি। এমনকি দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও তা চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয়াঙ্কাকে রাজি করানো গেল না। রাহুলও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ঝুঁকি নিলেন না। ওই নেতা এ কথাও বলেন, আমেথির তুলনায় রায়বেরিলি নিঃসন্দেহে নিরাপদ আসন। রাহুল রায়বেরিলিতে দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কাকে আমেথিতে প্রার্থী করলেও লড়াইটা জমে যেত। ইরানিকে যোগ্য জবাব দিতে পারতেন প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু তিনি রাজিই হলেন না।
রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলি লোকসভা আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন মা সোনিয়া গান্ধী, বোন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ও সভাপতি মল্লিকার্জুন খাগড়েসহ দলের নেতা–কর্মীরাফাইল ছবি: এএনআই
প্রিয়াঙ্কা রাজি হলেন না দুটি কারণে। তিনি মনে করেন, আমেথি বা রায়বেরিলিতে প্রার্থী হলে পরিবারতন্ত্র নিয়ে বিজেপির প্রচার আরও বেড়ে যেত। মা, ছেলে ও মেয়ে তিনজনেই সংসদ সদস্য হলে বিজেপির হাতে বাড়তি একটা ধারালো অস্ত্র তুলে দেওয়া হতো। দ্বিতীয় কারণ, বক্তা হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। কংগ্রেস প্রার্থীদের মধ্যে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। তাঁর ভাষণ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তীক্ষ্ণ। কারও কারও মতে, এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তা তিনিই। ভোটারদের সঙ্গে তিনি খুব দ্রুত সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতে পারেন। প্রিয়াঙ্কার যুক্তি, নিজে প্রার্থী হলে ঘুরে ঘুরে সবার জন্য ভাষণ তিনি দিতে পারতেন না।
কংগ্রেসের বহু নেতা মনে করেন, দুটি যুক্তির কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রিয়াঙ্কা প্রার্থী না হলেও কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র নিয়ে বিজেপির কথা বলা বন্ধ হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রার্থী হলেও তিনি অন্যত্র প্রচারে যেতে পারতেন। রায়বেরিলির মতো ‘নিরাপদ’ আসনে তাঁর পড়ে থাকার প্রয়োজনই হতো না। এই মহলের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, রাহুলের জন্য এখন তো তাঁকে কিছুটা বেশি সময় দিতেই হবে। নিজে দাঁড়ালেও তা-ই হতো। তিনি বলেন, ভাই-বোন দুজনেই চ্যালেঞ্জ নিলে উত্তর প্রদেশসহ গোটা দেশেই কংগ্রেসের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এক ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে যেত। তাতে হিন্দি বলয়ে লাভ ছাড়া লোকসান হতো না।
দ্বিতীয় কেন্দ্র হিসেবে রায়বেরিলি বেছে নেওয়ায় রাহুলকে নতুন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিজেপি বলছে, রাহুল ভয় পেয়েছেন। রাহুলের বলা কথা ধার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলতে শুরু করেছেন, ‘ডরো মাৎ, ভাগো মাৎ’। অর্থাৎ ভয় পেয়ো না, পালিয়ে যেয়ো না।
দুই আসন থেকে অনেক নেতাই লড়াই করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে রায়বেরিলি ও তৎকালীন অন্ধ্র প্রদেশের (এখন তেলেঙ্গানা) মেডক থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদিও ২০১৪ সালে গুজরাটের বরোদা ও উত্তর প্রদেশের বারানসি থেকে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভোট শুরু হওয়ার আগে। রাহুল রায়বেরিলিকে বেছে নিয়েছেন ওয়েনাডের ভোট শেষ হওয়ার পর।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (বাঁয়ে) ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীফাইল ছবি
এই মুহূর্তের জিজ্ঞাসা, ওয়েনাড ও রায়বেরিলি দুটি কেন্দ্র থেকেই রাহুল জয়ী হলে কোনটা রেখে কোনটা তিনি ছাড়বেন? ১৯৫২ ও ’৫৭ সালে রায়বেরিলি কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তাঁর পিতামহ ফিরোজ গান্ধী। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির রাজনারায়ণ এবং ১৯৯৬ ও ’৯৮ সালে বিজেপির অশোক সিং ছাড়া এই আসন আর কখনো কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়নি। রাহুল জিতলে সেই রায়বেরিলি তিনি রাখবেন নাকি গতবার প্রথম ভাগ্য পরীক্ষা করে জেতা ওয়েনাড? ওয়েনাড রাহুলকে দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় দিয়েছে। আমেথিতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাঁর সংসদ সদস্যের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেছে। রায়বেরিলি ধরে রেখে ওয়েনাড ছেড়ে দিলে দক্ষিণে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে যখন বিজেপি সেখানে পায়ের তলায় জমি খুঁজতে ব্যস্ত।
দ্বিতীয় অসুবিধাও আছে। কেরালা বিধানসভার ভোট ২০২৬ সালে। ওই রাজ্যে শাসনক্ষমতা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বদল হতো কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ও সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের মধ্যে। ২০২১ সালে বামফ্রন্ট সেই প্রথা প্রথম ভেঙে দেয় টানা দুবার ভোটে জিতে। দুই বছর পর সিপিএমকে হটিয়ে কংগ্রেস কেরালায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। এই অবস্থায় রাহুলের ওয়েনাড ত্যাগ করা বিবেচকের কাজ হবে কি?
নিশ্চিতই তা হবে না। সেই কারণে অন্য একটি সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারছে। কংগ্রেসের একাংশ মনে করছে, ভোটের ফল যদি আশানুরূপ হয়, ‘ইন্ডিয়া’ জোট যদি বিজেপিকে কোণঠাসা করতে পারে, তাহলে রাহুল ওয়েনাড রেখে রায়বেরিলি ত্যাগ করে প্রিয়াঙ্কাকে সেখান থেকে লোকসভায় জিতিয়ে আনতে পারেন। মোট কথা, আপাতত অনেক কিছুই নির্ভর করছে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর।