রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে নগরীর অন্তত ৫০টি জায়গায় ডিএনসিসির এয়ার পিউরিফায়ার (বায়ু পরিশোধন যন্ত্র) স্থাপনের পরিকল্পনা স্বল্পমেয়াদি প্রচেষ্টা হিসেবে প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সমাধান নয় বলে বলছেন বায়ুগবেষকেরা। বায়ুদূষণ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে মূল কারণগুলোর বিরুদ্ধে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ তাঁদের।
গত সোমবার গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটির নগর ভবনে এক পলিসি ডায়ালগে এসব যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনার কথা জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। প্রতিটি যন্ত্র ১০০ গাছের সমপরিমাণ বায়ু পরিশোধন ও শীতলীকরণে সক্ষম বলে দাবি করা হয়েছে।
ডিএনসিসি প্রশাসক আরও জানান, এ উদ্যোগের জন্য পৃষ্ঠপোষক বা স্পনসর পাওয়া গেছে এবং চলতি মাসেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সিটি করপোরেশনের কোনো অর্থ খরচ হবে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মোহাম্মদ এজাজ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি পাইলট প্রকল্প করে দেখতে চাই, ফলাফল কী আসে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসব। যদি ইতিবাচক না হয়, আমরা ভিন্ন উদ্ভাবনের দিকে যাব।’
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এ ধরনের পিউরিফায়ার স্থাপন করে সামগ্রিক বায়ুমানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনা কঠিন। বায়ুদূষণ রোধে স্বীকৃত উপায়গুলোর মধ্যে এয়ার পিউরিফায়ার নেই। এটি ছোট পরিসরে সাময়িক স্বস্তি পেতে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো যেতে পারে।
এয়ার পিউরিফায়ার ক্ষুদ্র ধূলিকণা, জীবাণু ও দূষণ সৃষ্টিকারী গ্যাসীয় পদার্থ শোষণ করে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। যন্ত্রগুলোতে সাধারণত ফিল্টার, কার্বন ফিল্টার বা ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ার পিউরিফায়ারের বড় আকারের ইউনিটগুলো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বায়ু শোধনে সক্ষম হলেও এগুলোর প্রভাব মূলত সীমিত এলাকাজুড়ে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, এইচডিসিটি ৫১০০০ মডেলের ৫০টি স্থির বায়ু পরিশোধন যন্ত্র বসানো হবে রাজধানীতে, যা প্রতি মিনিটে ৩০ হাজার ঘনফুট বায়ু পরিশোধন করতে পারবে। যন্ত্রটি বাতাসে থাকা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন করতে সক্ষম বলে যন্ত্র বিবরণী থেকে জানা গেছে।
প্রতীকী ছবি
একেকটি যন্ত্রের ওজন ১ হাজার ৫০০ কিলোগ্রাম, যা গড়পড়তা একটি টয়োটা করোলা গাড়ির সমান। যন্ত্রটি চালাতে ২২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ এটি বাসাবাড়িতে চালানো ফ্রিজ বা ওয়াশিং মেশিনের মতো ভোল্টেজে চলবে।
যন্ত্রটির বিবরণীতে বলা হয়েছে, এটি উচ্চ জনসমাগম এলাকাগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা অনুযায়ী, এটি বাতাসে অতিক্ষুদ্র কণার উপস্থিতির স্তর স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।
যন্ত্রটি যানবাহন ও শিল্প খাতের ধোঁয়াসহ সিগারেটের মতো ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাস থেকে টেনে নিতে সক্ষম।
গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটির নগরভবনে ‘দূষণমুক্ত ন্যায্য নগর গঠনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে বক্তব্য দেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজছবি: ডিএনসিসির সৌজন্যে
ঢাকার বায়ুমানের সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গত ২২ এপ্রিল কিছু তথ্য প্রকাশ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। কেন্দ্র জানায়, রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষ গত ৯ বছরে (৩ হাজার ১১৪ দিনের হিসাব) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছেন।
এ সময়ে ৮৫৩ দিনের বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। আর খুব অস্বাস্থ্যকর ও দুর্যোগপূর্ণ ছিল যথাক্রমে ৬৩৫ দিন ও ৯৩ দিন। ক্যাপস জানায়, দেশে প্রতিবছরই বায়ুদূষণ আগের চেয়ে বাড়ছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ বলছে, বায়ুদূষণে ওই বছর দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে তৃতীয় স্থানে ছিল ঢাকা।
আমরা একটি পাইলট প্রকল্প করে দেখতে চাই, ফলাফল কী আসে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসব। যদি ইতিবাচক না হয়, আমরা ভিন্ন উদ্ভাবনের দিকে যাব।
মোহাম্মদ এজাজ, ডিএনসিসির প্রশাসক
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এ ধরনের পিউরিফায়ার স্থাপন করে সামগ্রিক বায়ুমানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনা কঠিন। বায়ুদূষণ রোধে স্বীকৃত উপায়গুলোর মধ্যে এয়ার পিউরিফায়ার নেই। এটি ছোট পরিসরে সাময়িক স্বস্তি পেতে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো যেতে পারে।
দূষণ ঠেকাতে এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপন কার্যকর পদক্ষেপ নয় বলে মন্তব্য করেছেন বায়ুদূষণবিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় দেশগুলোও এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপনের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে খুব একটা সফল হতে পারেনি। হয়তো প্রাথমিকভাবে বেসরকারি কোম্পানি ব্যয় বহন করছে, তবে একটা সময় আমাদের এগুলো কিনতে হবে। সেদিকে না গিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে দূষণের উৎস খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধ করতে।’
একই কথা বলেন বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মাঠপর্যায়ে এখনো এয়ার পিউরিফায়ার টেকসই সমাধান নয়। কিছু জনপরিসরে এটি পরীক্ষামূলক একটি পদক্ষেপ হতে পারে। তবে বড় সমস্যা সমাধানের পথ নয়।’
অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, দেশের অর্থসামাজিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় এয়ার পিউরিফায়ার এখনো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট। যে দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বাতাস সেবন করছে, সে দেশে এয়ার পিউরিফায়ারকে আলাদা করে প্রমোট (উৎসাহিত) করার বিষয়টি ন্যায্যতার ঘাটতি ও বৈষম্যও বটে।
‘তবে নগর প্রশাসন বায়ুদূষণ নিয়ে ভাবছে, সমাধানের পথ খুঁজছে, বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছি,’ যোগ করেন কামরুজ্জামান।
বায়ুদূষণফাইল ছবি
বিশ্বে বিভিন্ন শহরে বড় আকারের এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপন করে দেখা গেছে, এগুলোর প্রভাব মূলত স্থানীয় পর্যায়ের ও সীমিত। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে দিল্লির কনট প্লেসে স্থাপন করা হয় ২৪ মিটার উচ্চতার একটি স্মগ টাওয়ার। এটি ৫০ মিটারের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বায়ুদূষণ কমাতে সক্ষম হলেও ৩০০ মিটারের বাইরে এর প্রভাব ছিল না বললেই চলে।
২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর এনডিটিভির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দিল্লির পরীক্ষামূলক স্মগ টাওয়ার বায়ুদূষণ হ্রাসে কার্যকর নয় বলে মত দেয় দিল্লি দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি। একই সঙ্গে ব্যয়বহুল বিশাল এয়ার পিউরিফায়ার চালানোর যৌক্তিকতা নেই বলেও দেশটির জাতীয় পরিবেশ আদালতকে জানায় সংস্থাটি।
এনডিটিভির খবর অনুযায়ী, সে সময় সংস্থাটি জোর দিয়ে বলেছে, স্মগ টাওয়ার বায়ুদূষণ সমস্যার কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান নয়।
বড় দেশগুলোও এয়ার পিউরিফায়ার স্থাপনের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে খুব একটা সফল হতে পারেনি। হয়তো প্রাথমিকভাবে বেসরকারি কোম্পানি ব্যয় বহন করছে, তবে একটা সময় আমাদের এগুলো কিনতে হবে। সেদিকে না গিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে দূষণের উৎস খুঁজে বের করে সেগুলো বন্ধ করতে।
আবদুস সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক
এত আলোচনার পরও বায়ুদূষণ বন্ধ হয় না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘সমাধান আসে না। কারণ, কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কথা বেশি বলি, কিন্তু কাজ করি কম। বায়ুদূষণ না কমার কারণ এটাই। শীতকালে যখন দূষণ বেড়ে যায়, তখন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা হয়, টাস্কফোর্স করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো আর নেওয়া হয় না।’
বায়ুদূষণ মোকাবিলায় মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন এই গবেষক। কার্যকর সমাধানগুলোর মধ্যে রয়েছে—পুরোনো ও কালো ধোঁয়া ছাড়ানো যানবাহন নিয়ন্ত্রণ; নির্মাণস্থলে ধুলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর নিয়ম প্রয়োগ; অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা; সবুজায়ন ও নগর–পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ এবং বায়ুর গুণমান মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করে দূষণের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।