পাঁজরের হাড় ও কপালের চামড়ায় তৈরি হবে সেই খোকনের নাক
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 06-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে আহত হন খোকন চন্দ্র বর্মণ। তাঁর ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু, এক চোখ—এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। এই পুরো অংশ মিলে বড় একটি গর্ত হয়ে আছে। সরকারি খরচে চিকিৎসার জন্য খোকন বর্তমানে রাশিয়ায় আছেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর পাঁজরের হাড় ও কপালের চামড়া দিয়ে নাক বানানো হবে। বাঁ চোখে আর দেখতে পাবেন না, সেখানে কৃত্রিম চোখ লাগানো হবে। থ্রিডি মডেলের মাধ্যমে তৈরি করা হবে তাঁর মুখের আদল।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি খোকন উন্নত চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় গেছেন। সেখানে এত দিন খোকনের শারীরিক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। থ্রিডি মডেল তৈরি হলে নিচের চোয়ালে কিছু প্লেট বসাতে হবে। আপাতত ১৪ এপ্রিল খোকনের প্রথম অস্ত্রোপচার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রথম অস্ত্রোপচার সফল হলে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। এভাবে একেক ধাপে এক মাস থেকে তিন মাসসহ বিভিন্ন মেয়াদে বিরতি দিতে হবে।

 

 

হোয়াটসঅ্যাপে খোকনের চিকিৎসার বিষয়ে প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান। তিনি খোকনের সঙ্গে রাশিয়ায় গেছেন। মাহমুদুল হাসান জানান, তিনি রাশিয়া থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি দেশটিতে কাজও করেছেন। তাই রুশ ভাষা বুঝতে পারেন, এ সুবিধার জন্যই তাঁকে সরকারিভাবে খোকনের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে খোকনের বিষয়ে তিনি এসব তথ্য জেনেছেন।

চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠানোয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন খোকন। তবে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে যাতে দ্রুত দেশে ফিরতে পারেন, সে জন্য তাঁর পাশে থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

২১ ফেব্রুয়ারি যাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হলো কি না, জানতে চাইলে চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়েছে—বিষয়টি আসলে তেমন না। এখানে (রাশিয়া) আসার পর খোকনের মুখে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। দুই সপ্তাহ ড্রেসিং করতে হয়েছে। চোখের চিকিৎসককে দেখানো, পুরো শরীর সিটিস্ক্যান করাসহ নানা পরীক্ষা করাতে হয়েছে। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে খোকনের মুখ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। চিকিৎসাটা ব্যয়বহুল এবং চিকিৎসা শেষ হতে কত দিন লাগবে, তা বলার কোনো উপায় নেই।

 

খোকনের বয়স ২৩ বছর। পেশায় গাড়িচালক। গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ওই দিনের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, নাক-মুখের অংশের মাংস প্রায় খুলে পড়ছে। তাঁর মুখ ও পুরো শরীর রক্তাক্ত। এ অবস্থাতেও তিনি একজনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। খোকন নিজেই আঙুলের ছাপ দিয়ে মুঠোফোনের লক খোলেন। সেই মুঠোফোন থেকেই একজন খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মণকে গুলি লাগার খবর দেন।

সব মিলিয়ে খোকনের মুখ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। চিকিৎসাটা ব্যয়বহুল এবং চিকিৎসা শেষ হতে কত দিন লাগবে, তা বলার কোনো উপায় নেই।

মাহমুদুল হাসান, খোকনের সঙ্গে থাকা চিকিৎসক

খোকনের স্বজনেরা জানান, খোকা ও খোকন একই কোম্পানিতে গাড়ি চালাতেন। খোকন যাত্রাবাড়ীতে থাকতেন; আর খোকা মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকেন।

গত ৯ অক্টোবর প্রথম আলোতে ‘গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, তালু, নাকের আর অস্তিত্ব নেই’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন খোকন ভর্তি ছিলেন ঢাকার (সাবেক নাম শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

বার্ন ইনস্টিটিউটে থাকার সময় এবং এখন রাশিয়াতেও খোকনকে মুখ সাদা গজ কাপড় দিয়ে ঢেকে চলাফেরা করতে হয়; যাতে অন্যরা ভয় না পান। চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান বলেন, রাশিয়ায় যেহেতু যুদ্ধ চলছে, তাই খোকনকে দেখে মানুষের মধ্যে অন্য ধরনের আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। রাস্তায় বের হলে দফায় দফায় পুলিশি তল্লাশিতে পড়তে হচ্ছে। গণপরিবহন ব্যবহার করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো খোকন সহজে মেনে নিতে পারেন না। মন খারাপ করেন।

মোবাইলে খোকন চন্দ্র বর্মণের পুরোনো ছবি।

মোবাইলে খোকন চন্দ্র বর্মণের পুরোনো ছবি।ফাইল ছবি

গুলিতে খোকনের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে তিনি বাঁচবেন তা পরিবারের সদস্যরা এমনকি বাংলাদেশের চিকিৎসকেরাও শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। শুরু থেকেই খোকনের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি আলোচনায় ছিল। চিকিৎসা যে ব্যয়বহুল, তা–ও জানা ছিল। খোকনের বর্তমান চেহারা দিয়ে পাসপোর্ট করা সম্ভব ছিল না, তাই সরকারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাঁর আগের ছবি দিয়েই পাসপোর্ট বানাতে হয়েছে।

চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, খোকনকে বিদেশে নিয়ে যেতে দেরি হচ্ছিল। রাশিয়া সরকার ভিসা দিয়ে সহায়তা করেছে। খোকনকে সরকারিভাবে রাশিয়ায় নেওয়া হয়েছে। রাশিয়ায় চিকিৎসার খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কত খরচ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যত খরচই লাগুক, সরকার তা বহন করবে।

আয়নার সামনে খোকন। এখন তিনি তাঁর চেহারা দেখে নিজেই ভয় পান। ছবিটি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ের

আয়নার সামনে খোকন। এখন তিনি তাঁর চেহারা দেখে নিজেই ভয় পান। ছবিটি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ের

খোকনের বাবা কিনা চন্দ্র বর্মণ রাজধানীর একটি হাসপাতালে শাকসবজি, মাছ-মাংস সরবরাহ করেন। মা রীনা রানী দাস এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। খোকনের ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। খোকন পড়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।

রাশিয়ায় যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন খোকন। দেশে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন থাকার সময় তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। তবে তাঁর কথা বেশ অস্পষ্ট। এবার রাশিয়া থেকে মেসেঞ্জারে লিখে প্রথম আলোর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি।

খোকন প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হচ্ছে। এতে তিনি হতাশ হয়ে পড়ছেন। আগের চেহারা আবার ফিরে পাবেন কি না, তা–ও জানেন না। তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠানোয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে যাতে দ্রুত দেশে ফিরতে পারেন, সে জন্য তাঁর পাশে থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

শেয়ার করুন