বিদ্যুৎ–গ্যাসে বকেয়া বেড়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 21-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। অর্থসংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না পিডিবি ও পেট্রোবাংলা। আবার চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না।

পিডিবি ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে বকেয়া বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী মার্চ মাসে গরম পড়া শুরু হলে জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকবে। কিন্তু দায়দেনার চাপে ঝুঁকিতে আছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও ভ্রান্ত নীতির কারণে জ্বালানি খাত এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ২০২২ সাল থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকট তৈরি হয়। তখন জ্বালানি আমদানি কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আবার বিল পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন করা যায়নি। তাই বিদ্যুৎ–ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক লোডশেডিং করা হয়। গত বছরের ৮ আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি তেলের বকেয়া শোধ হয়েছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের বকেয়া এখনো শোধ করা যায়নি।

পিডিবি ও পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী মার্চে গরম পড়া শুরু হতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে।

 

বকেয়া নিয়ে বেশি চাপে আছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। বকেয়া শোধে নিয়মিত তাগাদা পাচ্ছে তারা। তবে কিছুটা স্বস্তিতে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। বিগত সরকারের সময় বিপিসির বকেয়া ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। ইতিমধ্যে এসব বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসে আবার কিছুটা ডলার–সংকট তৈরি হয়েছে। বিপিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, বেশি দামে ডলার বিক্রি করতে ব্যাংকগুলোকে নিষেধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে চাহিদা অনুসারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ কোটি ডলার বকেয়া জমেছে বিপিসির। বছরে তাদের চাহিদা ৪২০ কোটি ডলারের বেশি।

পিডিবি ও পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী মার্চে গরম পড়া শুরু হতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। বোরো আবাদ, পবিত্র রমজান মিলে এবারের গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট ছাড়াতে পারে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে প্রাথমিক জ্বালানি (গ্যাস, তেল ও কয়লা) সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর না হলে বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে লোডশেডিং বাড়তে পারে।

এ কারণে চাহিদা অনুসারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ কোটি ডলার বকেয়া জমেছে বিপিসির। বছরে তাদের চাহিদা ৪২০ কোটি ডলারের বেশি।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরোনো বকেয়া ছাড়াও চলতি বছরের বিল পরিশোধে পিডিবি, পেট্রোবাংলা ও বিপিসি মিলে প্রায় ১১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের চাহিদা দিয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, আগের সরকার বকেয়া রেখে গেছে। জ্বালানি তেলের বকেয়া ইতিমধ্যে শোধ করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বকেয়া পরিশোধে করণীয় ঠিক করা হবে।

পিডিবির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল—১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়েছে গত বছর।

চুক্তি অনুসারে, নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। গত ডিসেম্বরের বিদ্যুৎ বিল এখনো জমা হয়নি।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নভেম্বর পর্যন্ত পিডিবির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাস বিল বকেয়া জমেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্যাস বিল না দিলে পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে না পেট্রোবাংলা। আর ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি পাবে সরকারি–বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বকেয়া শোধ না হলে জ্বালানি আমদানি করে উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না এসব কেন্দ্র।

বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি বকেয়া জমেছে ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এরা একাই পাবে ৭০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ করছে আদানি। বকেয়া শোধে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে ১৯ জানুয়ারি পিডিবির কাছে পৌঁছেছে আদানির চিঠি। এ কেন্দ্রের কয়লার বিল নিয়ে বিরোধ আছে। এটি এখনো সুরাহা হয়নি। তারা কয়লার বাড়তি দামে বিল জমা দিলেও পিডিবি বাজার দামে হিসাব করছে।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতি ইউনিটে গড়ে চার টাকার মতো লোকসান করে পিডিবি। ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয় সরকার। পিডিবি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির টাকা ছাড় করলে বকেয়া শোধ করতে পারবে পিডিবি।

এলএনজি ও শেভরনের বিল বকেয়া

গ্যাস সরবরাহ করে নিয়মিত বিল পাচ্ছে না পেট্রোবাংলা। গ্রাহকের কাছে ২৯ হাজার কোটি টাকার গ্যাস বিল পাবে পেট্রোবাংলার বিতরণ সংস্থাগুলো। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বকেয়া বিদ্যুৎ ও সার খাতে। সার কারখানার কাছে পাওনা ১ হাজার ১১ কোটি টাকা। ফলে গ্যাস আমদানির বিল, সরবরাহকারীর বিল ও শুল্ক-কর পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না তারা।

দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। প্রতিবছর তাদের গড়ে প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিল পরিশোধ করতে হয়। ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের বকেয়া জমেছে ১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ২ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বিল বকেয়া জমেছে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। এলএনজি রূপান্তরের জন্য দুটি টার্মিনালকেও প্রতি মাসে ডলারে বিল পরিশোধ করতে হয়।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, টাকা দিলেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ৯ জানুয়ারি ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধের জন্য ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক দিয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

 

পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস বিক্রি করে প্রতি ইউনিটে তাদের লোকসান হচ্ছে সাড়ে ৬ টাকা। তাই ঘাটতি কিছুটা পূরণে ইতিমধ্যে শিল্পে গ্যাসের দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব করেছে তারা। এ বছর এলএনজির দাম আরও চড়া। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করায় লোকসান হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর মোট ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানি করার পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এতে বছরে তাদের লাগবে ৪৫০ কোটি ডলার।

সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গত সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও ভ্রান্ত নীতির কারণে জ্বালানি খাত একটা দুষ্টচক্রে পড়েছে। শিগগিরই উত্তরণ প্রায় অসম্ভব। দুষ্টচক্র যাতে আর বড় না হয়, তাই দুই বছরের জন্য একটি সংকটকালীন পরিকল্পনা নিতে পারে সরকার। বকেয়া পরিশোধ, জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার, চুরি রোধ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনা করে খরচ কমানো, এলএলজি আমদানি কমিয়ে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়গুলো থাকতে পারে এতে।


 

শেয়ার করুন