বাংলাদেশের ইতিহাসে আর্থিক অঙ্কে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই প্রকল্পটি দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নও। সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের জন্য এক বিরাট অর্জন হবে। যদিও প্রকল্পের কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে এতদিনে। আগামী বছরের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম ১২০০ ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট পরবর্তী বছর উৎপাদনে আসবে।
গত বছরের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট-১ এর রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপন করেন তিনি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করে। ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট পাস করা হয়। ২০১৩ সালে প্রথম পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র জানায়, রুশ নকশা অনুযায়ী নির্মিত হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। প্রকল্পের দুটি ইউনিটেই তৃতীয় প্রযুক্তির বা ‘থ্রি প্লাস’ প্রজন্মের সর্বাধুনিক ‘ভিভিইআর-১২০০ রি-অ্যাক্টর’ স্থাপিত হবে। রিঅ্যাক্টরগুলোর কার্যকাল ৬০ বছর, যা প্রয়োজনে আরও ২০ বছর বৃদ্ধি করা যাবে।
আর্থিক বিবেচনায় রূপপুর এনপিপি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাশিয়া ৯০ শতাংশ দিচ্ছে ঋণ হিসেবে, যা প্রকল্প বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার পরবর্তী ২৮ বছরে পরিশোধ করা যাবে। প্রকল্প ব্যয়ের অবশিষ্ট ১০ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে বাংলাদেশ। রূপপুর দুটি ইউনিট থেকে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। কেন্দ্রটির সব যন্ত্রপাতি তৈরি ও সরবরাহ ও নির্মাণে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটম।
পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বলে আশা করছে সরকার। দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বর্তমানে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকায়।
প্রকল্পটির ইতিহাস
১৯৬১ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুর-কে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্বাচন করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বেশি কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়। পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে মেসার্স সোফরাটম কর্তৃক পরিচালিত ফিজিবিলিটি স্টাডির মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়। পরে ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানিকে দিয়ে দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। ওই স্টাডির মাধ্যমে প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্টাডিতে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নসহ কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। সরকার বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান ২০০০ অনুমোদিত হয়। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলি সম্পাদন শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৩ মে বংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশনের (রোসাটোম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। একই বছরের ১০ নভেম্বর সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট ২০১২ পাস হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।