ক্যাম্পাসের জন্য নিজস্ব ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ বানিয়েছে ‘তিন উস্তাদ’
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 18-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) তিন শিক্ষার্থীর উদ্যোগটি চমকপ্রদ বটে। ক্যাম্পাসের জন্য তাঁরা গড়েছেন নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নাম দিয়েছেন ‘বাউব্রেনিয়াম’।

এ কে এম ফজলে হাসান, মো. ফাহাদ হাসান ও মোহাম্মদ দিদারুল আনোয়ার—তিনজনই কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের অধীনে বায়োইনফরমেটিকস প্রকৌশল বিভাগে পড়ছেন। তাঁদের দলের নাম ‘তিন উস্তাদ’।

‘প্রথমে ভেবেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস কখন কোথায় আছে, সেটা সহজে বের করার জন্য একটা জিপিএস সিস্টেম বানাব,’ বলছিলেন ফাহাদ। ‘পরে বুঝতে পারি, শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বড় কিছু করা যায়, যা আমাদের পরে বাউব্রেনিয়ামের মতো বৃহত্তর একটি প্ল্যাটফর্মের ধারণা দিয়েছে, যেখানে শুধু প্রযুক্তিনির্ভরতা নয়, শিক্ষার্থীদের আবেগ, অভিজ্ঞতা ও সম্পর্কের জায়গাও তৈরি হবে।’

 

 

বাউব্রেনিয়াম এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন, শিক্ষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাবেন পরামর্শ, আবার নিজেদের ভাবনা ও কাজও তুলে ধরতে পারবেন। এর মাধ্যমে অন্যদের মধ্যেও ভালো কাজের আগ্রহ তৈরি হবে বলে উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস।

দলের আরেক সদস্য দিদারুল আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য শুধু মেসেজ দিয়ে কথা বলা বা পোস্ট দেওয়ার একটি মাধ্যম তৈরি করা নয়; আমরা চেয়েছি এমন একটি ডিজিটাল কমিউনিটি, যেখানে একই ছাতার নিচে যুক্ত হবেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনেরা। কেউ লিখবেন অনুপ্রেরণার কথা, কেউ জানাবেন উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞতা, আবার কেউ খুঁজে নেবেন নিজের ক্যারিয়ারের পথ। আমরা এটিকে একটি ডিজিটাল বুদ্ধিকেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাই।’

বাউব্রেনিয়ামে কী কী আছে, জানালেন দিদারুল আনোয়ার, ‘এখানে থাকছে প্রোফাইল তৈরি ও আপডেট করার সুযোগ। বন্ধুদের “সিক্রেট মেসেজ” পাঠানো, শিক্ষকের মূল্যবান উক্তি বা পরামর্শ পোস্ট করা, অনুজদের জন্য দিকনির্দেশনা ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা, তথ্য সংরক্ষণ—নানা ব্যবস্থা আছে। আপাতত স্টোরেজ বা মেমোরি কম হওয়ায় ভিডিও আপলোড করার সুযোগ রাখা হয়নি।’

প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করতে স্ট্যান্ডার্ড ওয়েব টেকনোলজি এইচটিএমএল-৫, সিএসএস ৩, জাভাস্ক্রিপ্ট এবং পিএইচপিভিত্তিক ব্যাকঅ্যান্ড ব্যবহার করা হয়েছে। ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্টের জন্য যুক্ত হয়েছে মাইএসকিউএল। হোস্টিং হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের স্থানীয় সার্ভিস ‘এক্সনহোস্ট’। বর্তমানে এটি বেটা ভার্সনে রয়েছে; অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। ৯ মে রাত ১০টায় চালু করার পর এখন পর্যন্ত ৪১৯ জন এতে যুক্ত হয়েছেন বলে জানান তিন উস্তাদ দলের এ কে এম ফজলে হাসান। সদস্য যাচাইপ্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা একটি উন্মুক্ত নিবন্ধনপদ্ধতি রেখেছি, যেখানে যেকোনো ই–মেইল ঠিকানা ব্যবহার করে যে কেউ সাইনআপ করতে পারছেন। শুরুতে ভাবিনি এত দ্রুত ৪০০–এর বেশি ব্যবহারকারী পেয়ে যাব। এক মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা একটি নিয়মতান্ত্রিক সদস্য যাচাইপদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা করছি। এর মধ্যে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ই–মেইল ব্যবহার করে যাচাই এবং বিভাগীয় সমন্বয়কদের সহায়তায় হাতে-কলমে যাচাই। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি বিভাগের ক্লাস প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, বাউব্রেনিয়ামকে শুধু বাকৃবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনদের জন্য একটি নিরাপদ ডিজিটাল জায়গা হিসেবে গড়ে তোলা।’

 

 

কেবল তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচার নয়, তথ্যসুরক্ষা নিয়েও বেশ সচেতন তিন উস্তাদ। এ বিষয়ে ফাহাদ হাসান বলেন, ‘ব্যবহারকারীর তথ্য এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন; অর্থাৎ সাংকেতিকভাবে রূপান্তর করে বাংলাদেশভিত্তিক সার্ভারে সংরক্ষণের মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের কোনো অনুপ্রবেশ বা ডেটা চুরির ঝুঁকি ন্যূনতম রাখা হয়েছে।’

বাউব্রেনিয়ামের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দিদারুল আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের তিনজনেরই বাউব্রেনিয়াম নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন আছে। ভবিষ্যতে এখানে ক্লাসের সময়সূচি, রিয়েল টাইম বাস ট্র্যাকিং, একাডেমিক ক্যালেন্ডার, অফিশিয়াল নোটিশ, ক্যাম্পাসের সংবাদ, চাকরি ও ইন্টার্নশিপের বিজ্ঞপ্তি, বিভাগভিত্তিক আলোচনার ব্যবস্থা, গবেষণা সহযোগিতা ও উপদেষ্টা প্যানেল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি মিললেই এসব বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মিডিয়া সাইট চালুর গুঞ্জন আগেও শোনা গেছে। সেগুলোর সঙ্গে বাউব্রেনিয়ামের পার্থক্য নিয়ে ফাহাদ হাসানের বক্তব্য, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক যেসব সোশ্যাল মিডিয়ার তৈরির দাবি আগে করা হয়েছে, সেগুলোতে পোস্ট করতে হলে অনুমতি নিতে হয়, নিজস্ব প্রোফাইল বানানোর সুযোগ নেই, আর ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানোরও সুযোগ নেই। ওই মাধ্যমগুলোতে যে কেউ চাইলেই প্রবেশ করতে পারেন। বাউব্রেনিয়াম এসব বাধা ভেঙেছে। এটি কেবল তথ্য দেখার প্ল্যাটফর্মই নয়, এটি একদিকে যেমন যোগাযোগের মাধ্যম, অন্যদিকে আবেগ, অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণারও জায়গা।’

বাউব্রেনিয়াম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেছবাহ উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে এমন একটি স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম তৈরি হওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়। দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যম থাকলেও বাকৃবিতে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। বাউব্রেনিয়াম এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটি এমন একটি ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক বিষয়, ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, উচ্চশিক্ষার সুযোগ বা গবেষণার বিষয়েও মতবিনিময় করতে পারবেন। কেউ যদি বিদেশে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে চান, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা এখান থেকেই পাওয়া যাবে। আবার যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁরা উপযুক্ত সুপারভাইজর খুঁজে পেতে বা প্রয়োজনীয় জার্নাল ও ডেটা শেয়ার করতেও এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারবেন। তথ্যের নিরাপত্তা ও যাচাই ব্যবস্থাগুলো পরিপূর্ণভাবে চালু হলে এটি বাকৃবি পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী ও নিরাপদ তথ্যকেন্দ্র হয়ে উঠবে।’

শেয়ার করুন