দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এক ধাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সহকারী শিক্ষকদের শুরুর বেতন গ্রেড ১২তম এবং প্রধান শিক্ষকদের ১০তম গ্রেড হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি’র সুপারিশ এবং আদালতের রায়ের আলোকে এই উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের সুপারিশ করা উন্নীত গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বেতনস্কেল উন্নীতকরণের চেকলিস্ট অনুযায়ী প্রস্তাব দিতে বলেছে অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরকে এই চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়।
তবে, এ বিষয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষকেরা বলছেন তাঁরা এই উদ্যোগ মানবেন। তাঁদের মূল দাবি সহকারী শিক্ষকদের শুরুর বেতন গ্রেড ন্যূনতম ১১ তম করতে হবে। এই দাবিসহ তিন দফা দাবিতে তাঁরা কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে, প্রধান শিক্ষকেরা বলছেন, আদালতের রায়ের আলোকে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এটি কেবল রিট আবেদনকারী শিক্ষকদের জন্য নয়, সব শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমানে সারা দেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌনে চার লাখের মতো শিক্ষক আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান শিক্ষকদের বর্তমান বেতন গ্রেড ১১ তম। আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩ তম (শুরুর মূল বেতন ১১ হাজার টাকা, এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যোগ হয়)।
পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শতাধিক সুপারিশ করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটি ‘সহকারী শিক্ষক’ পদ বিলুপ্ত করে শুরুর পদ ‘শিক্ষক’ করার সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ‘শিক্ষক’ হিসেবে শুরুতে বেতন গ্রেড হবে ১২তম (শুরুর মূল বেতন হবে ১১ হাজার ৩০০ টাকা, এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যোগ হবে)। এরপর দুই বছর পর চাকরি স্থায়ীকরণ ও আরও দুই বছর পর তাঁরা ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হবেন। তখন তাঁদের বেতন গ্রেড হবে ১১ তম। পরামর্শক কমিটি প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১০তম করার সুপারিশ করেছে। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায়ে প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১০তম করতে বলা হয়েছে।
এখন পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ও আদালতের রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী নেওয়ার জন্য তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
সর্বোচ্চ রায়ের আলোকে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা, মুখপাত্র, বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি
সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়েছিল। তখন প্রশিক্ষণ পাওয়া ও প্রশিক্ষণবিহীন দুই ধরনের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১তম করা হয়। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড করা হয় ১৩তম। তার আগে প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রধান শিক্ষকেরা ১১তম গ্রেডে এবং প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকেরা ১২তম গ্রেডে বেতন পেতেন। অন্যদিকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা ১৪তম গ্রেডে ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকেরা ১৫তম গ্রেডে বেতন পেতেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে জানিয়ে আসছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এ অবস্থায় সরকারের নতুন এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১২তম করার উদ্যোগ তাঁরা মানেন না। তাঁরা চান সহকারী শিক্ষকদের শুরুর পদের বেতন গ্রেড ন্যূনতম ১১ তম গ্রেড হতে হবে। এই দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে যাবেন।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সহকারী শিক্ষকেরা দাবি আদায়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সংগঠনটি তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তিন দফা দাবি হলো; পরামর্শক কমিটির সুপারিশের যৌক্তিক সংস্কার করে সহকারী শিক্ষক পদে শুরুর পদ ধরে ১১ তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, চাকরিতে ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতিসহ দ্রুত পদোন্নতি। এই তিন দফা দাবি পূরণে সরকারকে ৪ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে সংগঠনটি। যদি এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হয় তাহলে ৫ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এক ঘণ্টা করে কর্মবিরতি, ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত দুই ঘণ্টা করে এবং ২১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করা হবে। এরপরেও দাবি পূরণ না হলে ২৬ মে থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির মুখপাত্র ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সর্বোচ্চ রায়ের আলোকে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডসহ দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা রাখবে। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণের তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে এই পদমর্যাদা ও বেতন গ্রেড সব প্রধান শিক্ষকের জন্য কার্যকর করে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সবার জন্য এটি কার্যকর না হলে প্রধান শিক্ষকেরা বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের পরিবর্তে আরও আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হবেন।