আর্থিক অনটনের কারণে এসএসসি পাসের পর ছেলেকে আর পড়াতে চাইলেন না বাবা আবুল কাশেম তালুকদার। মালয়েশিয়ায় পাঠাতে জমি বিক্রি করে দালালকে টাকাও দিলেন। কিন্তু ছেলে পড়াশোনা করতে চায়। ছেলে বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকবে ভেবে মায়ের মনও সায় দিচ্ছিল না। সে জন্য এক রাতে মা আসমা আক্তার ছেলেকে বললেন, ‘তুই চুপি চুপি মামার বাড়ি চলে যা।’
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মামার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়াশোনা শুরু হলো ছেলেটির। তবে মামার নির্দেশ ছিল, সকালে-বিকেলে তাঁর মুরগির ব্যবসায়ে বসতে হবে। সেভাবেই চলছিল। কিছুদিন পর সহপাঠীরা তাঁকে মুরগির ব্যাপারী বলে খ্যাপাতে লাগল। তখন উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হলেন। অন্যের বাসায় জায়গির থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দির এই ছেলে এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর নাম মো. নাজমুল ইসলাম। করোনার পরিস্থিতিতে ২০২২ সালে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানার যাবতীয় কাঁচামাল বেচাকেনার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করেন। এর নাম দেন ‘ফেব্রিক লাগবে’। এর মাধ্যমে প্রান্তিক তাঁতিরা সহজেই নিজেদের চাহিদামতো সুতা ক্রয় এবং পরে নিজেদের উৎপাদিত কাপড়ও বিক্রির সুযোগ পান। এর বাইরে রং ও রাসায়নিক বেচাবিক্রি হতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে। শুধু তা–ই নয়, এতে তাঁতিদের উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি এবং গামছাও ন্যায্যমূল্যে বিক্রি শুরু করেন নাজমুল।
ফেব্রিক লাগবে প্ল্যাটফর্মে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার তাঁতি ও ব্যবসায়ী তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে যুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ক্রেতার সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার। প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে বর্তমানে বছরে ১০-১২ কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়।
নাজমুল ইসলাম ও তাঁর ফেব্রিক লাগবে প্ল্যাটফর্ম নতুন করে আলোচনায় এসেছে চলতি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে চার প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়। ইনোভেশন বা উদ্ভাবন শ্রেণিতে পুরস্কার পায় ফেব্রিক লাগবে লিমিটেড। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাত থেকে পুরস্কার নেন ফেব্রিক লাগবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. নাজমুল ইসলাম।
উত্তর বাড্ডায় ফেব্রিক লাগবের কার্যালয়ে গত বুধবার নাজমুল ইসলামের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি বলেন, ‘ফেব্রিক লাগবে প্রান্তিক তাঁতি, ক্ষুদ্র বস্ত্রকল ও তৈরি পোশাক কারখানার ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।’
পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা শেষ করে ২০০৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন নাজমুল ইসলাম। চাকরি নেন নাভানা পাওয়ার জেনারেশনে। বেতন ১৩ হাজার টাকা। চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিতে মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (তড়িৎ যন্ত্র প্রকৌশল) ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ মেটাতে প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে যেতেন নাজমুল ইসলাম। সেখান থেকে আনারস, কলা, আম ইত্যাদি ফল নিয়ে এসে ঢাকার কারওয়ান বাজারে বিক্রি করতেন। তাতে যে মুনাফা হতোম তা দিয়ে কয়েকটি দেশও ঘোরেন।
বছর দেড়েক কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে মালয়েশিয়া থেকে সার্জিক্যাল গ্লাভস আমদানি শুরু করেন নাজমুল ইসলাম। ২০১২ সালে নরসিংদীতে নুসাইবা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে বস্ত্র কারখানা স্থাপন করেন। শুরুতে স্থানীয় বাজারের জন্য কাপড় তৈরি করলেও পরে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির জন্য আলাদা কারখানা করেন।
ফেব্রিক লাগবে প্ল্যাটফর্মে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার তাঁতি ও ব্যবসায়ী তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে যুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ক্রেতার সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার।
করোনাকালে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের অনেকের রপ্তানি ক্রয়াদেশ বাতিল হয়। নাজমুল ইসলামেরও আড়াই কোটি টাকার কাপড়ের রপ্তানি আদেশ বাতিল করে দেয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। এ রকম অবস্থায় লোকসান কিছুটা কমানো যায় কি না, সে চিন্তা থেকে কাপড় বিক্রির উদ্দেশ্যে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে যান। তিনি কাপড়ের যে দাম চাচ্ছিলেন, তার ধারেকাছেও দিতে চাচ্ছিলেন না সেখানকার পাইকারেরা। তখন যেন চোখে অন্ধকার দেখেন এই তরুণ ব্যবসায়ী।
নাজমুল ইসলাম বললেন, ‘মার্কেটের বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। মাথায় তখন চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, এভাবে আমি কাপড় বিক্রি করতে পারব না। আমার এমন কিছু করতে হবে, যাতে হাজার হাজার ক্রেতার সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করা যায়। আমি তৎক্ষণাৎ আমার লোকজনকে বললাম, কাপড় বেচা হয়ে গেছে। তোমরা সবাই ট্রাকে কাপড় তোলো।’ তিনি বলেন, ‘এরপর প্রায় তিন মাস শুধু পরিকল্পনা করেছি। তারপর জমানো টাকা নিয়ে ওয়েবসাইট বানানোর কাজে নেমে পড়ি।’
ফেব্রিক লাগবের পথচলা
ওয়েবসাইট করতে গিয়েও বেশ ঝক্কির মধ্যে পড়েন নাজমুল ইসলাম। প্রথমে কয়েক মাস কাজ করার পর একটি প্রতিষ্ঠান তা ছেড়ে দেয়। তখন আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ শেষ করেন। তারপর প্রান্তিক তাঁতিদের মধ্যে ফেব্রিক লাগবে প্ল্যাটফর্মকে পরিচিত করতে নরসংদী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও অনেক টাকা বিনিয়োগ করেন। অবশেষে ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি ফেব্রিক লাগবে যাত্রা শুরু করে।
ফেব্রিক লাগবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি প্রচলিত ই-কমার্স থেকে কিছুটা আলাদা। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার আলাদা আইডি থাকে। বিক্রেতা (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান) তাঁর উৎপাদিত পণ্য সুতা, কাপড় কিংবা অন্য কোনো পণ্যের ছবিসহ অন্যান্য তথ্য আপলোড করেন। ব্যবসায়ী সেই পণ্য কিনতে চাইলে প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমেই দর-কষাকষি করতে পারেন। এভাবে ফেব্রিক লাগবের মাধ্যমে বেচাকেনা হয়ে থাকে।
এর বাইরে ক্ষুদ্র তাঁতিদের ন্যায্য দামে সুতার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ফেব্রিক লাগবে। কারণ, ক্ষুদ্র তাঁতিরা অল্প পরিমাণে সুতা কেনেন। কিন্তু স্পিনিং মিল অল্প সুতা বিক্রি করে না। সে জন্য ফেব্রিক লাগবে বিভিন্ন স্পিনিং মিল থেকে বিপুল পরিমাণ সুতা কেনে। তারপর সেই সুতা তাঁতিদের কাছে বিক্রি করে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের পর এখন প্রতিটি উপজেলায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির কাজ করছেন নাজমুল ইসলাম। বললেন, ‘প্রান্তিক তাঁতিদের পণ্য আমরা উপজেলায় পৌঁছে দিতে চাই। এ জন্য উপজেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করব। পুরো কাজটি আমরা ডিজিটাল মাধ্যমে করব। নতুন এই প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পেলে কাজটি সহজ হবে।’