মে মাস ঘূর্ণিঝড়প্রবণ মাস। গত দেড় যুগে (২০০৭ থেকে ২০২৫) এই মাসে ১২ বার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর আঘাত পড়েছে উপকূলে। চলতি মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, মাসের শেষে একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। যদিও অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদদের যাঁর সঙ্গেই কথা বলেছি, তিনি বারবারই জোর দিয়ে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা কম; বরং একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। বাস্তবেও তা–ই হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ঘূর্ণিঝড়’ নিয়ে আলোচনার দাপট লক্ষ করা গেছে। এর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নানা কথাও বলা হয়েছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল ‘শক্তি’।
উত্তাল সাগরফাইল ছবি
গত মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। গতকাল বুধবার তা সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। আজ বৃহস্পতিবার ভোরে এটি নিম্নচাপে পরিণত হয়। পরে তা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে আজ বেলা ৩টার দিকে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেছেন, ‘নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে উপকুল অতিক্রম শুরু করেছে। এর গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী এটি স্থলভাগের দিকে উঠে আসছে। এ থেকে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার আশঙ্কা নেই।’
সাগরে প্রথম লঘুচাপ, তারপর সুষ্পষ্ট লঘুচাপ, পরে নিম্নচাপ থেকে গভীর নিম্নচাপ এবং শেষে তা ঘূর্ণিঝড় হয়। এবার শুরুর প্রক্রিয়াগুলো একই রকম ছিল। কিন্তু শেষতক ঘূর্ণিঝড় হলো না। কেন?
এ প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদেরা কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এর প্রথম কারণ হিসেবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম কামরুল হাসান মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কথা বলেছেন। তাঁর কথা, ‘মৌসুমি বায়ু এবার সময়ের আগেই দেশে প্রবেশ করেছে। আর তা অনেকটাই সক্রিয়। এই সক্রিয়তা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে দেয়নি।’
গত শনিবার (২৪ মে) বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটে। ওই দিন ভারতের কেরালা উপকূলেও মৌসুমি বায়ুর আগমনের খবর পাওয়া যায়। সাধারণত মৌসুমি বায়ু ভারতের কেরালা উপকূল স্পর্শ করলে প্রায় একই সময় বাংলাদেশের উপকূলেও তা এসে পড়ে।
মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাধারণত প্রবেশ করে ৩১ মে থেকে ১ জুনের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে এর অবশ্য ব্যত্যয় হচ্ছিল। স্বাভাবিক সময় থেকে গত প্রায় দেড় দশকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করত। এবার ১৬ বছর পর এর ব্যতিক্রম হলো।
আবহাওয়ার বার্তা বলছে, মৌসুমি বায়ু আজ ঢাকা বিভাগের পূর্বাঞ্চলসহ বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।
এস এম কামরুল হাসান বলছিলেন, ‘যখন মৌসুমি বায়ুর প্রাবল্য থাকে, তখন ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির সঞ্চয় কমে যায়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য প্রবল গরম হাওয়ার সঞ্চয় দরকার। মৌসুমি বায়ু এতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এর শক্তি ক্ষয় হয়। বায়ুর প্রাবল্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে না। এবারও তা–ই হয়েছে। এখন মৌসুমি বায়ু অনেকটাই সক্রিয়।’
এবার যে গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা আজই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আর এতে ব্যাপক বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর। আগামী চার থেকে পাঁচ দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি থাকতে পারে। তবে আগামীকাল শুক্রবারের পর বৃষ্টি কমে যেতে পারে বলেই আবহাওয়ার বার্তায় বলা হয়েছে।
মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার পাশাপাশি লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার এলাকা এবার ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি না হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে—এমনটাই মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ এস এম কামরুল হাসান বলেন, সাগরের যেখানে লঘুচাপটি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলের একেবারে কাছাকাছি। সেখান থেকে উপকূলমুখী হতে বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য যে সময় দরকার, সেটি তা পায়নি।
সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন কাজে বের হওয়া মানুষ। ৭ নম্বর ঘাট এলাকা, খুলনা, ২৯ মে
আজ সকাল ছয়টার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আজ ভোরের দিকেই নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। নিম্নচাপটি ওই সময় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ–পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ–পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি উত্তর দিকে এগিয়ে আরও ঘনীভূত হওয়ার কথাও বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলছিলেন, ‘উপকূল থেকে এত কাছে নিম্নচাপে পরিণত হয়ে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের সময় পায়নি। এই শক্তিহীনতাই সম্ভাব্য সেই ঘূর্ণিঝড় “শক্তি”কে শক্তি সঞ্চয় করতে দেয়নি। এটি আর ঘূর্ণিঝড়েই রূপ নেয়নি।’
তবে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় গত দেড় দশকে প্রায়ই দেখা গেছে। এই তো গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’ আঘাত করেছিল বাংলাদেশের উপকূলে। ২০২৩ সালের ১৪ মে ‘মোখা’, ২০২১ সালের ২৭ মে ‘ইয়াস’, ২০২০ সালের ২১ মে ‘আম্পান’, ২০১৯ সালের ৪ মে ‘ফণি’, ২০১৭ সালের ৩১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৬ সালের ২২ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানা’, ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’, ২০১০ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘লায়লা’, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০০৮ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’, ২০০৭ সালের ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আকাশ’ উপকূলে আঘাত করেছিল।
এসব ঘূর্ণিঝড় শক্তিমত্তা দেখিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে। এতে প্রাণহানি হয়েছে অনেকের। সম্পদ নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এবার ‘শক্তি’ নাম নিয়ে আসার কথা ছিল যে ঘূর্ণিঝড়ের, সেটি শক্তিমত্তা দেখানোর সুযোগই পেল না। এখন যে গভীর নিম্নচাপ হলো, তা ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিতই হবে না। এতে প্রাণ বাঁচল, সম্পদের ক্ষতিও কম হবে। যদিও ঝোড়ো হাওয়া আছে। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়।
আর জলবায়ুর নানা মডেল বলছে, বাংলাদেশের উপকূলে বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা আসলে বাড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার জানান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোসফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের একদল গবেষক। গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের বড় ঝড় ১০০ বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। এই ঝুঁকি অঞ্চল ও মৌসুমভেদেও ভিন্ন হতে পারে।