গণতন্ত্র ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয় এবং একাধারে সুষ্ঠু বা মানসম্পন্ন নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। গণতন্ত্র যেহেতু জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার নাম, তাই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া ও জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন খুবই জরুরি। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা মিশ্র প্রকৃতির। এখানে যেমন মানোত্তীর্ণ কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে, ঠিক তেমনি নির্বাচনের নামে তামাশাও মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, তা নির্বাচনের নামে প্রহসন-প্রতারণা ছাড়া কিছুই ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল সুর তাই ছিল ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধ, আমাদের নির্বাচনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার অর্থবহ সংস্কার।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যাতে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে, এমন নিশ্ছিদ্র নির্বাচনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ভবিষ্যতে নির্বাচনী আইন বা বিধির অপব্যবহার রোধ করে নির্বাচনের ফলাফলে জনমতের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটানো এ সংস্কারের উদ্দেশ্য।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো এ রকম: ১. নির্বাচনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা; ২. আইনানুগভাবে ভোটার হওয়ার যোগ্য সব নাগরিকের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার অবারিত সুযোগের নিশ্চয়তা; ৩. নির্বাচন প্রশাসনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা; ৪. নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি; ৫. পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নির্দলীয় প্রার্থীদের প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা; ৬. ভোটারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান তথা ভয়ভীতিহীন পরিবেশে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা এবং ৭. নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিরোধ পক্ষপাতহীন ও ন্যায়সংগতভাবে যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকা।
আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীন যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটিই সুষ্ঠু ও সঠিক হয়নি। পক্ষান্তরে যে কয়টি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, তার সব কটিই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন হয়েছে। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে বাংলাদেশের প্রায় সব কটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তাতে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে বাছাই করা মুষ্টিমেয় সৎ, নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও তাঁদের পক্ষে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হবে। তাই নির্বাচনী সংস্কারের প্রথম ধাপেই আমাদের সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে; যদিও নির্বাচন সুষ্ঠু ও সঠিক হওয়ার জন্য শুধু একটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যমান থাকাই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে আরও কিছু অতীব জরুরি বিষয় রয়েছে। সেসবও সংস্কারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
হার্ভার্ডের অধ্যাপক নির্বাচন-গবেষক পিপা নরিসসহ আরও অনেকেই উল্লেখ করেছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা একটি বহুমাত্রিক জটিল প্রক্রিয়া, যাতে রয়েছে নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচনোত্তর বিষয়াদি। সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে গেলে এর সব কটিতেই নজর দিতে হবে। পণ্ডিতেরা নির্দিষ্টভাবে ১১টি ধাপবিশিষ্ট নির্বাচনপ্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। সে আলোকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরার চেষ্টা করব।
এ কে এম ওয়ারেসুল করিম ও মাহবুবুর রহমান
১. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দিতে হলে এবং নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে সর্বাগ্রে নির্বাচন কমিশনে তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার সাধন করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যোগ্য ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তিসম্পন্ন একটি কমিশন গঠনের লক্ষ্যে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে গঠিত চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনার, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদের মধ্যে যাঁরা জীবিত, কর্মক্ষম ও দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক, তাঁদের নিয়ে একটি পুল গঠন করে তা সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতরণ করে যাঁদের ব্যাপারে তাঁদের আপত্তি নেই, এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে কমিশনার ও একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের বিবেচনা।
২. প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য একটি নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্রের সংখ্যার দ্বিগুণসংখ্যক কর্মকর্তার একটি প্যানেল নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে প্রার্থীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া এবং ওই তালিকায় উল্লেখিত কারও নামে প্রধান প্রধান দলের প্রার্থীদের কোনো আপত্তি থাকলে তা আমলে নিয়ে যথাসম্ভব ক্ষেত্রে তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান প্রবর্তন।
৩. সন্ত্রাস, গোলযোগ, কেন্দ্র দখলসহ যেকোনো কারণে কোনো কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে কমিশন বা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র বা কেন্দ্রগুলোর অথবা সমগ্র নির্বাচনী আসনের নির্বাচন স্থগিত অথবা বাতিল করার সর্বময় ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করার বিধান সমুন্নত করা।
৪. ভোট গণনা শেষ হওয়ার পরপরই অথবা যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্র থেকেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কর্তৃক লাউড স্পিকারে ঘোষণা করার বিধান প্রণয়ন।
৫. কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল সব প্রার্থীর এজেন্টের স্বাক্ষর এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষরসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা আরোপের বিধি প্রবর্তন।
৬. কেন্দ্রের ফলাফল বিবরণীতে স্বাক্ষরের জন্য সব প্রার্থীর এজেন্টকে কেন্দ্রে অথবা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নাগালের মধ্যে পাওয়া না গেলে অন্ততপক্ষে ওই কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের ক্রমানুসারে সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থান অধিকারী প্রার্থীর এজেন্টের স্বাক্ষর গ্রহণ এবং অনুরূপ স্বাক্ষর ব্যতিরেকে প্রেরিত বিবরণী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বৈধ বলে বিবেচিত না হওয়ার বিধান প্রণয়ন।
৭. ভোটার তালিকায় নিবন্ধনপ্রক্রিয়া যথাসম্ভব সহজ ও জনবান্ধব করার জন্য নির্বাচনের এক মাস আগপর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলমান রাখা এবং দেশের যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটার হওয়ার সুযোগ অবারিত করা।
৮. ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি বুথকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা এবং নির্বাচনের দিনের ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা, ফলাফল বিবরণীতে স্বাক্ষর করা, কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা ইত্যাদি সার্বিক কর্মকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা রাখার বিধান প্রণয়ন।
৯. ভোট প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে ভোট গ্রহণ সকাল সাতটা থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা।
১০. নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার রোধ করতে অনৈতিক মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন মনোনীত প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলে সদস্যপদের মেয়াদ ন্যূনতম তিন বছর নির্ধারণ।
১১. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ন্যূনতমসংখ্যক নারী প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের বিধান বিবেচনা করা।
১২. নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা। একই সঙ্গে দাখিলের ছয় মাসের মধ্যে যাবতীয় অভিযোগের নিষ্পত্তিকরণের বিধান প্রণয়ন করা।
১৩. নিবর্তনমূলক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনপ্রথা বিলোপ করা দরকার। দেড় দশক ধরে আইনটি বিরোধী দল ও মত দমনের একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রাক্কালে কমিশন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সক্রিয় রাজনৈতিক দলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে নাম-ঠিকানাবিহীন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিয়ে সরকারের অভিপ্রায়ের কাছে আত্মসমর্পণের দলিল রেখে গেছেন। বিধানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী। কোনো রাজনৈতিক দলের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক জেলা বা উপজেলায় কার্যালয় বা কমিটি নেই বলে দেশের কোনো অংশেই দলটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না-এমন আইন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শামিল বিধায় অবিলম্বে বাতিলযোগ্য।
১৪. স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংসদীয় আসনের ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর যুক্ত করার বিধান বিলোপ প্রয়োজন। বিধানটি হয়রানিমূলক, নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার তথা সর্বজনীন মানবাধিকারের পরিপন্থী। স্বীয় প্রার্থিতার সমর্থনে কয়েক হাজার ভোটারের স্বাক্ষর জোগাড় করতে না পারলে কোনো নাগরিক নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না-এমন বিধান হাস্যকর এবং একাধারে নিবর্তনমূলক।
১৫. আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি বিবেচনা করা দরকার। সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি-বিশ্লেষক নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টনের প্রস্তাব করেছেন। পদ্ধতিটি তাত্ত্বিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও এর প্রায়োগিক জটিলতা ও সমস্যা বহুমাত্রিক। তাই এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশীজনের মতামত গ্রহণের কাজ শুরু করা প্রয়োজন এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উচ্চ মানসম্পন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের নির্বাচনপদ্ধতি ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌলিক সংস্কার এ মুহূর্তে জাতীয় অগ্রাধিকার। এ জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থার সার্বিক পর্যালোচনা করে কোথায় কোথায় কী কী পরিবর্তন বা সংশোধন আনয়ন করা যায়, তা নির্ধারণে ব্যাপক জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন।
বদিউল আলম মজুমদার যথার্থই বলেছেন যে অতীতের তিনটি নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা পরিহার করতে হবে এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করতে হবে। জনগণের আস্থা ফিরে পেতে পূর্ববর্তী নির্বাচনী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে নতুন করে নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন অপরিহার্য।
এ কে এম ওয়ারেসুল করিম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান