নিখোঁজের ১৫ বছর পর রাঙামাটিতে পাওয়া গেলো ফেনীর ‍খোকা‍কে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 04-06-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বিয়ের কেনাকাটা করতে ফেনী শহরে গিয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সী মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে খোকা। সঙ্গে ছিলেন পরিবারের কয়েকজন। কেনাকাটার এক পর্যায়ে শৌচাগারে যান তিনি। এরপর তার আর কোনও খোঁজ মিলছিল না। বৃহস্পতিবার (৩০ মে) মোস্তাফিজ যখন পরিবারের কাছে ফিরলেন ততদিনে তার যৌবন থেকে ১৫টি বসন্ত হারিয়ে গেছে!

২০০৯ সালে যেদিন মোস্তাফিজুর রহমান নিখোঁজ হন সেদিন তার সঙ্গে ফেনী শহরে গিয়েছেন তার বোন বিবি রহিমাও। তিনি জানান, ভাইয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করেছিলেন তারা। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার পর একদিন বিকেলে মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে বিয়ে ও গায়ে হলুদের কাপড় কেনার জন্য সোনাগাজীর পালগিরি গ্রামের বাড়ি থেকে ফেনী শহরে যান।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তারা বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। এমন সময় মোস্তাফিজ শহরের একটি শৌচাগারে প্রস্রাব করতে গিয়ে আর ফেরেননি। এরপর পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন নানাভাবে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি। তারা থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরিও করেন।

মোস্তাফিজের পারিবারিক ও স্থানীয়রা জানান, সুস্থ সবল দেহের অধিকারী ছিলেন তিনি। অথচ কেনাকাটা করতে গিয়ে তরতাজা একটি যুবক হারিয়ে গেল! অবশেষে ১৫ বছর পর রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় তার সন্ধান মিলল!

মোস্তাফিজুর রহমান খোকা সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের পালগিরি গ্রামে আবদুর রাজ্জাকের একমাত্র ছেলে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় অবস্থান করা এই ব্যক্তি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খোকা নামে পরিচিত।

বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে মোস্তাফিজকে তার পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকার মো. মোস্তফাসহ স্থানীয় মসজিদ ও সমাজ কমিটির লোকজন।

মোস্তাফিজের বোন বিবি রহিমা জানান, ‌কয়েকদিন আগে মো. আকাশ নামে তাদের এক প্রতিবেশী ব্যবসায়িক কাজে রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকায় গিয়ে মোস্তাফিজকে একটি দোকানে চা খেতে দেখেন। এ সময় আকাশ তাকে চিনতে পেরে কাছে গিয়ে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারছিলেন না। পরে আকাশ তার মুঠোফোনে মোস্তাফিজের একটি ছবি তুলে বাড়িতে পাঠান। বাড়ির লোকজন সবাই ছবি দেখে হারিয়ে যাওয়া মোস্তাফিজকে শনাক্ত করেন। এরপর আকাশ মোস্তাফিজকে বাড়ি ফিরে আনতে তবলছড়ি এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
 
বৃহস্পতিবার দুপুরে স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু সুফিয়ানসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রাঙামাটি তবলছড়ি কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় মো. মোস্তফা নামে এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়া ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তবে বিগত ১৫ বছরের বা তার আগের কোনও কথা বা স্মৃতি তার মনে নেই।

মোস্তাফিজকে আশ্রয় দেয়া মো. মোস্তফা জানান, ২০০৯ সালের দিকে রাঙামাটি তবলছড়ি এলাকায় আসেন মোস্তাফিজ। তিনি তার নিজের ও পরিবারের বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন খোকা এলাকার সবার কাছে হয়ে ওঠেন ঘনিষ্ঠজন। মাঝে মধ্যে এলাকার মানুষের ঘরে গিয়ে ভাত বা টাকা খুঁজতেন তিনি। পরে মোস্তফা নামের ওই ব্যক্তি তাকে বাড়িতে নিয়ে আশ্রয় দেন। চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকা আগের কিছুই মনে করতে ও বলতে পারতেন না। তাদের ধারনা মলম পাটির খপ্পরে পড়ে বা অন্য কোনও কারণে খোকা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
 

দীর্ঘ ১৫ বছর পর হলেও খোকাকে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আনন্দিত মো. মোস্তফা তিনি বলেন, ‘বিদায় বেলায় খোকার জন্য মন কেঁদে উঠে। মানসিক ভারসাম্যহীন এই ব্যক্তি আমাদের পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলেন। তিনি পরিবারকে খুঁজে পেয়েছেন, এটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।’
 
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু সুফিয়ান জানান, মোস্তাফিজকে আর ফিরে পাবেন, সেটি তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। তাকে দেখাশোনা করায় রাঙামাটির তবলছড়ি এলাকার মো. মোস্তফাসহ বাসিন্দাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। বাড়িতে আসার পর মোস্তাফিজকে দেখে এক আবেগগণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সে কাউকে চিনতে পারছে না। এবার তাকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলা হবে।
 

মোস্তাফিজের মা নুরজাহান বেগম (৭০) বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ‘আমার কলিজার টুকরা সন্তানের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতি রাতে তার থাকার ঘরের বিছানা ঠিক করে দিতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার ছেলে আমার কোলে আসবে। আমি মনে করেছিলাম, সে অনেক কষ্টে আছে। কিন্তু তাকে রাঙ্গামাটির লোকজনের খুব আদর করে যত্নে রেখেছিল। তার বিয়ের জন্য ঠিক করা ওই পাত্রীর পরিবারও প্রায় তিন-চার মাস অপেক্ষা করেছিল। এরপর তাকে খুঁজে না পাওয়ায় ওই পাত্রীর অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে।’

শেয়ার করুন