পাকিস্তানে টিভি ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছে দিল্লি পুলিশ, বাসিত আলী বলছেন, ‘না, জিনিসপত্রের যা দাম...’
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 24-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবেশী মানেই কলহ, প্রতিবেশী মানেই মায়ার বাঁধন। কখনো মুখ দেখাদেখি বন্ধ, একজন আরেকজনের বাড়ির পাশও মাড়ায় না। কখনো আবার ‘এসো ভাই বুকে এসো...’ বলে বুকে টেনে নেওয়া হয়। সম্পর্কের এই এপিঠ-ওপিঠ মিলেই তো মানবজীবন।

সেই জীবনে পাশের বাড়িতে গোলমালের আওয়াজ পেলে প্রতিবেশীর ভাবনাটা এমনও হয়, ঠিকই আছে! যেমন কর্ম তেমন ফল! তবে আওয়াজটা থালাবাসন ভাঙার হলে ঠিক আছে। শুধু রক্তারক্তি না হলেই চলবে। তখন আবার প্রতিবেশীর জন্য মন কেঁদে ওঠে। অর্থাৎ ভালো যে খুব একটা চাই, সেটাও যেমন নয়, তেমনি বড় ক্ষতিও প্রত্যাশিত নয়। দিল্লি পুলিশও যেমন পাকিস্তানের ক্ষেত্রে চায়নি।

 

ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক বৈরী সম্পর্কের ব্যাপারটি সবারই জানা। সীমান্তে এমনিতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কেউ কাউকে কথায়ও ছাড় দেয় না। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অতিথি হলে ভিন্ন কথা। সবাই নিজ নিজ ঘরের (দেশের) মান রাখতে ‘এসো ভাই বুকে এসো...’ বলে যেমন কাছে টেনে নেয়, তেমনি দুর্দিনে কুশলী সান্ত্বনার বাণী ছুড়ে মুখ টিপেও হাসে।

এই পিচেই বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছে—তারা প্রতিপক্ষকে আটকে রেখেছিল, স্বস্তিতে রান করতে দেয়নি।

ইনজামাম উল হক, পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক

কীভাবে? সেই কথাই বলছি। তার আগে বলুন তো, ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের ময়দানি লড়াই শেষে কলহের আওয়াজ কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আসে? পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝতে পারবেন। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে যদি হিসাব করেন, এ সময়ে পাঁচবারের মুখোমুখিতে প্রতিবার ভারতের কাছে হেরেছে পাকিস্তান। আর প্রতিটি হারের পরই সীমান্তের ওপাশ থেকে ভেসে আসে কলহ-বিবাদের আওয়াজ। বাড়িতে একাধিক গৃহকর্তা হলে কোনো ভুলের পর যেমন হয়—‘এর ওটা ঠিক নেই, ওটা হয় না, ওকে বের করে দাও...’ এমন সব আওয়াজ আসে। ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে উঠলে হাতাহাতিও হতে পারে! প্রতিবেশী হিসেবে পাকিস্তানকে নিয়ে দিল্লি পুলিশের টেনশনটা ঠিক এখানেই। থালাবাসন ভাঙার আওয়াজ আসুক, কিন্তু রক্তারক্তি যেন না হয়! হাজার হোক, প্রতিবেশী বলে কথা!

 

তা ছাড়া ব্যাপারটা অমূলকও নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ইউটিউবে ভিডিওগুলো এখনো ভাসছে এই শিরোনামে—ভারতের কাছে হারের পর টিভি ভাঙলেন পাকিস্তানি সমর্থক। দুশ্চিন্তা তো তাই হয়ই। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কাল ভারতের কাছে পাকিস্তানের ৬ উইকেটে হারের পর দিল্লি পুলিশ তাই আর বসে থাকতে পারেনি।

 

‘বাড়ির গুরুজন’রা এমনিতে সীমান্তের ওপাশের প্রতিবেশীর সঙ্গে রণক্ষেত্রের বাইরে কথা বলা থেকে মুখ দেখাদেখিতে নিষেধ করলেও দিল্লি পুলিশ যোগাযোগের জন্য খুব কুশলী ভূমিকা নিয়েছে। যেন সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে—ঠিক সেভাবেই যেন বার্তাটা পৌঁছে দেওয়া যায়, আর সে জন্য যেন মুখ দেখাদেখিও না হয়। নইলে মুরব্বিরা মারবে! ঠিকই ধরেছেন। এই কাজে অব্যর্থ অস্ত্র হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম! প্রতিবেশীর দুশ্চিন্তায় দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে সেখানে পোস্ট করা হয়, ‘প্রতিবেশী দেশ থেকে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আশা করি, সেগুলো যেন শুধু টিভি ভাঙার আওয়াজ হয়।’

এবার ভারতের কাছে একতরফাভাবে হারলেও মনে হয় না টিভি ভাঙাভাঙি হবে। দেশে জিনিসপত্রের যা দাম।

বাসিত আলী, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার

দিল্লি কিংবা কলকাতা পুলিশের এই বিশিষ্ট প্রতিবেশী নিয়ে দুশ্চিন্তা নতুন না। খেলাধুলার ময়দানি লড়াইয়ে প্রতিবেশীদের হারের পর তাঁরা এর আগেও এমন দুশ্চিন্তাসূচক বার্তা দিয়েছেন তাঁদের প্রতি। এ বিষয়ে কারও কারও বাংলা সিনেমার কিছু কিংবদন্তি চরিত্রাভিনেত্রীকে মনে পড়তে পারে—রওশন জামিল, সেতারা আহমেদ, মায়া হাজারিকা...। সিনেমার চরিত্রে তাঁদের দেখা যেত, প্রতিবেশীর প্রতি তির্যক রসালো বাক্যবাণে তাঁদের যেমন জুড়ি নেই, তেমনি বড় কোনো ক্ষতিতেও তাঁদের মন কেঁদেছে। অর্থাৎ প্রতিবেশীর ভোগান্তি ভালো লাগে, মৃত্যু নয়। তিলে তিলে মারব, কিন্তু মরবে না, শুধু যাতনা পাবে।

লাহোরে গতকাল টিভিতে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ দেখেন দুজন দর্শক

লাহোরে গতকাল টিভিতে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ দেখেন দুজন দর্শকএএফপি

কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অবশ্য বলে গেছেন, ‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে...।’ পাকিস্তানের অবস্থাও যেন তেমন। প্রতিটি হারের পরই পাকিস্তান ওলট-পালট হয়। গর্জে ওঠেন সাবেকেরা—‘একে বাদ দাও, ওর হয় না, ও কিসের বাড়ির কর্তা!’ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে শুধু হাতাহাতিটাই বাদ থাকে, কিন্তু আওয়াজ হয় প্রচুর। তাতে সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, প্রতিবেশী হিসেবে দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম তো হবেই। ভারতেরও হয়েছে। অথচ ভারতীয় প্রতিবেশীরা বুঝতে পারছেন না, এটাই পাকিস্তানের ধর্ম। এ ওলট-পালট কিংবা প্রতিবারই সবকিছু ঢেলে সাজানোর দাবি ‘বিষে’ নীল হওয়াই পাকিস্তান ক্রিকেটে রোজনামচার জীবন। তাই বিষে বিষে সয়ে গেছে বলেই যাতনাটা তাঁরা টের পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে, অপ্রত্যাশিত কিছুর পর এমন শোরগোল ওঠাই তো স্বাভাবিক। কলহ-বিবাদপূর্ণ বাড়িতে যেমন হয় আরকি!

 

বাসিত আলী সেই কলহ-বিবাদপূর্ণ বাড়ির বাস্তব অবস্থাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। লোকে বাইরে থেকে ধনী ভাবলে কী হবে, ভেতরে-ভেতরে তো আসলে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জোগাড়! তাই টিভি ভাঙাটা এই বাড়ির জন্য যে এখন বিলাসিতা, সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের এই সাবেক, ‘এবার ভারতের কাছে একতরফাভাবে হারলেও মনে হয় না টিভি ভাঙাভাঙি হবে। দেশে জিনিসপত্রের যা দাম। শুধু কথা হবে।’

মানছি বাবর আজম পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু সে ইনজামাম নয়। ইনজামাম ভাই কঠিন সব পরিস্থিতিতে ম্যাচ জিতিয়েছেন। বাবর আজ পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে একটি ম্যাচও জেতাতে পারেনি।

মোহাম্মদ হাফিজ, পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক

পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক, সাবেক নির্বাচক ও সাবেক কোচ মোহাম্মদ হাফিজ সেভাবেই কথা বলেছেন। এ পৃথিবী জানে শাহিন আফ্রিদি, নাসিম শাহ ও হারিস রউফ পাকিস্তানের সেরা বোলার। নির্বাচক কিংবা কোচ থাকাকালে এই হাফিজই তাঁদের প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। আর কাল ভারতের বিপক্ষে শাহিন ২টি উইকেট পেলেও নাসিম ও হারিস পাননি। কিন্তু দল তো হেরেছে, পাকিস্তান ক্রিকেটে ঐতিহ্য মেনে তলোয়ারের কোপ তো চালাতেই হবে। ‘প্রফেসর’ সাহেব তাই ভোল পাল্টালেন, ‘লোকে তাদের দক্ষ বললেও বড় টুর্নামেন্টে জেতানোর সামর্থ্য নেই, নিজেদের প্রমাণ করতে পারেনি। তাই তাদের পাশ থেকে সরে এসে মোহাম্মদ আলী, খুররম শাহজাদ, আকিফ জাভেদদের খেলানো হোক।’ এসব খেলোয়াড় প্রসঙ্গে হাফিজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যও যোগ করেন, ‘তারাও পাকিস্তানি। আর তাদেরও পাকিস্তানি পাসপোর্ট আছে।’

শাহিন আফ্রিদি ভারতের বিপক্ষে দুটি উইকেট নিলেও তাঁকেও বাদ দিতে বলেছেন মোহাম্মদ হাফিজ

শাহিন আফ্রিদি ভারতের বিপক্ষে দুটি উইকেট নিলেও তাঁকেও বাদ দিতে বলেছেন মোহাম্মদ হাফিজএএফপি

এমনকি এ মুহূর্তে পাকিস্তান নামের বাড়ির ‘বড়কর্তা’কেও কর্তা মানতে রাজি নন হাফিজ। পরীক্ষায় ফেল করার পর পাশের বাড়ির ছেলেটিকে দেখিয়ে বাড়ির লোকজন যেমন বলে, ‘তুই ওর...খেয়ে কিছু শেখ’—হাফিজও ঠিক সেই সুরেই বাবর আজমকে নিয়ে বলেছেন, ‘বাবর আজম সত্যিকারের রাজা নয়; আসল রাজা বিরাট কোহলি।’

শুধু কি তাই, ধরুন বাড়ির সিনিয়র কোনো সদস্য অতীতে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। প্রায় সব পরীক্ষায়ই কৃতিত্বের সঙ্গে উতরে গেছেন। এখন যে ছেলেটি ফেল করেছে, তার সামনে সে সিনিয়র সদস্যের অতীত কীর্তির উদাহরণ এনে তুলনা টানা তো আমাদের জীবনে নতুন না। হাফিজও সেভাবেই বলেছেন, ‘মানছি বাবর আজম পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু সে ইনজামাম নয়। ইনজামাম ভাই কঠিন সব পরিস্থিতিতে ম্যাচ জিতিয়েছেন। বাবর আজ পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে একটি ম্যাচও জেতাতে পারেনি। ১০ বছর হয়ে গেল খেলছে। “সেনা” (ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা) দেশগুলোতে সিরিজ-সেরাও হতে পারেনি।’

বাবরকে নিয়ে তাঁর দেশ পাকিস্তানেই প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে

বাবরকে নিয়ে তাঁর দেশ পাকিস্তানেই প্রচুর সমালোচনা হচ্ছেএএফপি

হাফিজ যাঁর উদাহরণ টেনেছেন, সেই মহিরুহ ইনজামাম এমনিতে চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, বয়সও হয়েছে, ভারটা ধরে রাখতে হয়। কিন্তু সেই ইনজামামও এবার বাড়ির ‘বাচ্চাকাচ্চা’দের পরীক্ষা-ব্যর্থতায় সিনেমার জাঁদরেল চরিত্রদের মতো উঠে দাঁড়িয়ে ‘কী এত্ত বড় লজ্জা...’ বলে; নাহ ইনজামাম এসব কিছুই বলেননি। তবে যেটুকু বলেছেন, তাতে ভাবার বিষয় আছে।

ধনী দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বিবাদ থাকলে এবং তার মধ্যে একটি পরিবারের বাচ্চাকাচ্চারা পরীক্ষায় খারাপ করলে বাড়ির মুরব্বিরা কিন্তু শত্রুতা কিংবা ঈর্ষা থেকে আরেকটি ধনী পরিবারের সন্তানদের উদাহরণ টানেন না। তাঁরা টানেন দুটি বাড়ি থেকে আরেকটু দূরে অবস্থিত জেলেপাড়ার কোনো বাড়ির ছেলেপুলেদের উদাহরণ, ‘এই পিচেই বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছে—তারা প্রতিপক্ষকে আটকে রেখেছিল, স্বস্তিতে রান করতে দেয়নি।’

 

প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা এমনই, যে ইনজামাম বাংলাদেশের সেই প্রতিপক্ষের নাম পর্যন্ত মুখে আনেননি! পাছে মুখ নষ্ট হয় তাই? নাহ, তেমনটি হয়তো না। তাহলে শত্রুতার মজাই তো থাকল না। তবে নিজেদের এই কলহ-বিবাদের মধ্যেই পাকিস্তান নামের বাড়িটি নিয়ে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কথাটি বলেছেন, এই বাড়িরই আরেক উজ্জ্বল সন্তান ওয়াসিম আকরাম। দুষ্টুমি ও প্রতিভায় যিনি লুব্ধকের চেয়ে কম কিছু না! তাঁর চোখে পড়েছে একটি দৃশ্য, ‘মাঠে ৮-১০ শতাংশ ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। পাকিস্তান ১৫-১৮ ওভার বোলিংয়ের পরই তারা সবাই মাঠ ছেড়ে যেতে শুরু করেন। পাকিস্তানের ইতিহাসেই আমি কখনো এমন দেখিনি।’

ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে দুবাই স্টেডিয়ামে গ্যালারিভর্তি দর্শক। তবে ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের সমর্থকেরা হতাশ হয়েছেন

ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে দুবাই স্টেডিয়ামে গ্যালারিভর্তি দর্শক। তবে ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের সমর্থকেরা হতাশ হয়েছেনএএফপি

আসলেই তাই। ক্রিকেট নামের গ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটি বাড়ির মধ্যে একটির আকর্ষণ দিন দিন কমছে। কিন্তু জেলেপাড়ার ওই দরিদ্র বাড়িটি তা দেখেও বুঝতে পারছে না, সময় এখন নিজ গুণে এগিয়ে এসে জায়গা দখলের। নইলে অন্য কেউ জায়গাটা নিয়ে নেবে। সে জন্য নিজের কাজটা ভালোমতো না করে জেলেবাড়িটি যেন আশ্রয় নিয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমানে, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই “ধনী বাড়িতে”, এখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।”’

অথচ ধনী কিংবা ভদ্রপল্লি এমনিতে হয় না, বানিয়ে নিতে হয়।

শেয়ার করুন