নতুন বছরের আজ প্রথম দিন। এই প্রথম দিনেই অনুষ্ঠিত কোনো ম্যাচের ক্যাচ দেখে যদি রব ওঠে, এটাই বছরের শেষ ক্যাচ, তাহলে ব্যাপারটা বাড়াবাড়িও মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যাঁরা এই কথা বলছেন, দোষটা তাঁদের নয়।
দোষ গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের। ক্যাচটা তিনি যেভাবে ধরেছেন, তাতে বছরের বাকি ৩৬৪ দিনে যদি আরও ৩৬৪টি চোখধাঁধানো ক্যাচও দেখা যায়, তবু কারও কারও চোখে এই ক্যাচই সেরা হয়ে থাকবে। ধারাভাষ্যকার মার্ক হাওয়ার্ড তো ঘোষণাই করেছেন, ‘বছরের সেরা ক্যাচ...আমার মনে হয় না এর চেয়ে ভালো ক্যাচ কখনো দেখেছি।’
ঘটনা আজ ব্রিসবেনে বিগ ব্যাশে ব্রিসবেন হিট ও মেলবোর্ন স্টারসের মধ্যে ম্যাচে। আগে ব্যাটিংয়ে নামা ব্রিসবেনের ইনিংসে ১৬.১ ওভারে স্পিনার ড্যান লরেন্সকে লং অনে তুলে মেরেছিলেন ব্রিসবেনের উইল প্রেসউইজ। বলটি বাতাসে ভাসতে সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাটিতে আর নামতে পারেনি; কারণ, শূন্যে ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। ক্যাচ ধরার প্রক্রিয়া শেষে ধারাভাষ্যে বলা হয়েছে, ‘হি ইজ আ ফ্রিক শো!’
সেই শো–ই ভালোভাবে বলা যাক। এই ঘরানার ক্যাচ আপনি প্রচুর দেখেছেন। বল হয়তো বাতাসে ভাসতে ভাসতে সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে, একদম সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার ক্যাচটি ধরলেও হয়তো শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারেননি। উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে তৎক্ষণাৎ বলটি শূন্যে ছুড়ে সীমানার বাইরে পা রেখে আবারও ভেতরে এসে ক্যাচ নিতে দেখা মোটেও নতুন কিছু নয়।
কিংবা বাউন্ডারি সীমানার বাইরে চলে গেলে বলটি আসামাত্র লাফ দিয়ে হাতের ধাক্কায় বাউন্ডারির ভেতরেও পাঠাতে দেখা গেছে, সেখানে আরেকজন ফিল্ডার থাকলে ক্যাচ নিতে দেখাও নতুন নয়। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল যা করেছেন, তাতে কারও সাহায্যই লাগেনি। উপস্থিত বুদ্ধি এবং অ্যাথলেটিজমের মিশেলে হুট করে যেন সুপারম্যান হয়ে গিয়েছিলেন!
প্রেসউইজের মারা বলটি বেশ গতির সঙ্গে সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। মেলবোর্নের ফিল্ডার ম্যাক্সওয়েলও তাঁর ডান দিকে দৌড় দেন। যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছেন, বলটি সীমানার ভেতরে থেকে নিতে পারবেন না, তখনই লাফ দেন। বাকিটা বারবার চোখ রগড়ে দেখার মতো দৃশ্য।
লাফ দিয়ে সীমানার বাইরে গিয়ে বলটি ডান হাতে ধরে আবার ছুড়ে দিয়েছেন সীমানার ভেতরে—ম্যাক্সওয়েল এসবই করেছেন শূন্যে থাকতে! মানে লাফ দিয়ে মাটিতে নামার আগেই বলটি ধরে অবিশ্বাস্য দ্রুততা ও রিফ্লেক্সের সঙ্গে ছুড়ে দিয়েছেন সীমানার ভেতরে। আর সেই বল ছুড়ে দেওয়া এতই মাপমতো যে দৌড়ে সীমানার ভেতরে ঢুকে ক্যাচটি ধরার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন আরামেই।
সাধারণত বেশ গতির ওপর লাফ দেওয়া অবস্থায় হাতে থাকা বল শূন্যে ছুড়লে সেটা অনেক দূরে গিয়েও পড়তে পারে, যেহেতু কাজটা করতে হচ্ছে মিলিসেকেন্ড ব্যবধানের মধ্যে। কিংবা বলটা মাথার ওপরও উঠে যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ম্যাক্সওয়েলের বল ছুড়ে দেওয়ার মাপও ছিল যেন সার্জনের সার্জিক্যাল নাইফ ব্যবহারের মতোই—সীমানায় ঢুকে প্রথম ধাপেই ক্যাচটি নিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম এই ক্যাচকে তুলনা করছে বাস্কেটবল কিংবদন্তি লেব্রন জেমসের ‘অ্যালে-ওপিং’–এর সঙ্গে। দলীয় সমন্বয়, নিখুঁত পাসিং, টাইমিং ও ফিনিশিং—এই চারটি বিষয়ের সমন্বয়ে সফল ‘অ্যালে–ওপিং’ সম্পন্ন করা হয়। ইউটিউবে এই নামে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন, আক্রমণে উঠে সে মুহূর্তের খেলাটি আসলেই চোখধাঁধানো।
একজন খেলোয়াড় বাস্কেটের খুব কাছে বলটি তোলেন, সেটাও তাঁর সতীর্থ যে সময়ে লাফ দেবেন, সেই হিসাবটা বুঝে। যেন লাফ দিয়ে উঠে শূন্যে থাকা অবস্থায় বলটি ধরে ‘বাস্কেট’ করতে পারেন। তো, বলটি তোলার পর কেউ একজন, শূন্যে লাফিয়ে বলটি ধরে শূন্যে থাকতেই এক হাতে বাস্কেট করেন।
লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্সের কিংবদন্তি লেব্রন জেমস ‘অ্যালে-ওপিং’ খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন বলে তাঁর উদাহরণ টানা হয়েছে। তবে বাস্কেটবলে এই দক্ষতা পঞ্চাশের দশকেই দেখা গেছে। বোস্টন সেল্টিকসের কে সি জোনস ও বিল রাসেল সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার সময় এভাবে বাস্কেট করেছেন।
তবে ‘অ্যালে-ওপিং’–এর সঙ্গে তুলনায়ও ম্যাক্সওয়েলের ক্যাচটি একটি জায়গায় অনন্য। শূন্যে এক হাতে ক্যাচটি ধরে তাঁকে বলটি এমন জায়গায়, এমন এক উচ্চতায় ছুড়তে হয়েছে, যেটা সীমানার ভেতরে ঢুকে ধরতে পারবেন। কিন্তু ‘অ্যালে-ওপিং’-এ খেলোয়াড় শূন্যে থাকতেই ‘অন দ্য ফ্লো’তে বাস্কেট করার সুবিধাটা পান, ম্যাক্সওয়েলকে মাটিতে নেমে আবারও দৌড়ে সীমানার ভেতরে ঢুকতে হয়।
ফক্স ক্রিকেটে ধারাভাষ্য দেওয়া ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন বলেছেন, ‘কী দুর্দান্ত ক্যাচ! (শূন্যে থাকতে) সে যেভাবে (শরীরের) ভারসাম্য রেখে (বলটা) ধরল এবং হাতটা ঘুরিয়ে বলটা ছাড়ার সময় যেভাবে ভারসাম্য রাখল, সেটা অসাধারণ।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিগ ব্যাশের ইতিহাসে এটাই সেরা ক্যাচ কি না? এক্সে মেলবোর্ন স্টারসের করা পোস্টেই তোলা হয়েছে এ প্রশ্ন। ইংলিশ বার্মি আর্মির এক্স হ্যান্ডলে ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘হাতের কাজ ফেলে এটা দেখুন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল সর্বকালের সেরা একটি (ক্যাচ) নিলেন।’ আর কেএফসি বিগ ব্যাশের এক্স হ্যান্ডলে বলেই দেওয়া হয়েছে, ‘মৌসুমের সেরা ক্যাচ।’
অথচ ১৫ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এবারের বিগ ব্যাশ শেষ হবে ২৭ জানুয়ারি। আজকের ম্যাচেও অবশ্য শেষ হাসিটা হাসতে পেরেছেন ম্যাক্সওয়েলই। দল যে জিতেছে। ব্রিসবেন হিটের ১৪৯/৭ রান তাড়া করতে নেমে ১১ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটে জিতেছে মেলবোর্ন। ম্যাক্সওয়েল অবশ্য রান পাননি। পেয়েছেন ‘গোল্ডেন ডাক’, অর্থাৎ প্রথম বলেই আউট। তাতে কী, দল জিতেছে এবং ‘গোল্ডেন ক্যাচ’ও তো পেয়েছেন ম্যাক্সওয়েল।