সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট—বাক্যটি শুনেছেন নিশ্চয়! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রল পেজগুলোতে হরহামেশা পড়ছেনও। দুটি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও অনেক দিক থেকে মিল আছে বা ‘রিমেক’ করা হয়েছে, সাধারণত এ রকম কিছু বোঝাতে কথাটি ব্যবহার করা হয়।
২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া বলিউডের হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র ‘বোম্বে টু ব্যাংকক’-এ ‘সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট’ নামে একটি গান আছে। পরের বছর একই নামে মুক্তি পায় একটি জার্মান চলচ্চিত্র। এ বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে এই নামে মোশাররফ করিমের একটি নাটকও প্রচারিত হয়েছে।
তবে বেশির ভাগ ভাষাবিজ্ঞানীর ধারণা, বাক্যটি এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। থাইয়েরা কথা বলার সময় এ ধরনের ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে থাকে, যেটিকে বলা হয় ‘টিংলিশ’। কারও কারও মতে, ‘সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট’ কথাটির উৎপত্তি ভিয়েতনাম থেকে।
সে যা–ই হোক, খেলার খবরে ‘সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট’ নিয়ে এত আলোচনার কারণ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আরও স্পষ্ট করে বললে আইসিসি আয়োজিত চলমান ও সর্বশেষ ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। এই দুই প্রতিযোগিতা ‘সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট’ নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে।
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপর পর ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালেও জায়গা করে নিয়েছে এই চার দলছবি: ফেসবুক
এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে গ্রুপ পর্বের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। তার আগেই নির্ধারণ হয়ে গেছে চার সেমিফাইনালিস্ট—ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। সর্বশেষ বৈশ্বিক ওয়ানডে আসর ২০২৩ বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল এই চার দল। দুই বছর আগের বিশ্বকাপ হয়েছিল ভারতে, এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হচ্ছে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে। অর্থাৎ, ভেন্যু আর সাল আলাদা ভিন্ন হলেও সেমিফাইনালে ওঠা দলগুলো একই। ‘সেইম সেইম বাট ডিফারেন্ট’ নয়তো কী!
আরও কয়েক বছর পেছনে ফিরে যেতে চান? তাহলে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথা মনে করুন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো কোনো বৈশ্বিক আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে সেই বছর। তাই এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সালটা ভোলার কথা নয়। ওই বিশ্বকাপেও শেষ চারে উঠেছিল ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া।
অনেক দিন হলো ভারত এশিয়ার সেরা দল—এ ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। বৈশ্বিক আসরে নিয়মিতই তারা সেমিফাইনালে খেলে থাকে। ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত রোহিত-কোহলিরা শুধু একবারই আইসিসির সীমিত ওভারের প্রতিযোগিতার শেষ চারে নাম লেখাতে পারেনি—২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
অধিনায়কদের এই প্রতীকী ছবি দেখেই বোঝার কথা, কারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে উঠেছে আর কারা গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছেছবি: ফেসবুক
দক্ষিণ আফ্রিকা তো বেশির ভাগ সময় ‘চোক’ করে সেমিফাইনালে গিয়েই। এবি ডি ভিলিয়ার্স, ডেল স্টেইন, হাশিম আমলা, জেপি ডুমিনিদের জমানা পেরিয়ে প্রোটিয়াদের ভরসা এখন এইডেন মার্করাম, কাগিসো রাবাদা, হাইনরিখ ক্লাসেনরা। তাঁরা ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ আর ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মাঝে দেশকে আরও উঁচুতে নিয়েছেন। ২০২৪ সালে মার্করামের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমবারের মতো খেলেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল। দলটি আগামী জুনে প্রথমবারের মতো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও খেলবে।
ইতিহাস স্মরণ করলে এতক্ষণে ভারতীয় সমর্থকদের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ার কথা। বৈশ্বিক আসরে ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে খেলেছে—এমন কোনো টুর্নামেন্টেই শিরোপা জিততে পারেনি ভারত।
অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে নতুন করে কিছু না বললেও চলে। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল তারা। অস্ট্রেলিয়াকে সেমিফাইনালে রেখেই যেন বাকিদের খেলতে নামার কথা ভাবতে হয়। যদিও প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউডরা না থাকায় এই দলকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খুব বেশি আশা ছিল না। কিন্তু স্টিভেন স্মিথের নেতৃত্বাধীন দলটি ঠিকই সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে।
সেমিফাইনালের প্রসঙ্গ আনলে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডও বেশ ধারাবাহিক। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত সীমিত ওভারের ছয়টি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের মধ্যে পাঁচটিরই শীর্ষ চারে জায়গা করে নিয়েছে। আজ দুবাইয়ে ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ খেলেই কিউইরা লাহোরে সেমিফাইনাল খেলতে চলে যাবে।
দুবাইয়ের কন্ডিশন ও পিচ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে গেছে রোহিত শর্মার ভারতছবি: এএফপি
ভারতীয় দল নিজেদের সব ম্যাচ দুবাইয়ে খেলবে, তা সবার জানা। এক ভেন্যুতে সব ম্যাচ হওয়ায় ভারতকে ভ্রমণ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না। এ কারণে রোহিত শর্মার দল সেখানকার কন্ডিশনের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিয়েছে, পিচ সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে গেছে। এটা ভারতকে বিশাল সুবিধা দিচ্ছে বলে দাবি করেছেন ইংল্যান্ডের সাবেক দুই অধিনায়ক মাইক আথারটন ও নাসের হুসেইন, একই ধারণা পোষণ করেছেন চোটের কারণে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে না পারা অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্সও। যে কারণে অনেকের অনুমান, ফেবারিট ভারতই হয়তো শিরোপা জিততে চলেছে।
কিন্তু ইতিহাস স্মরণ করলে এতক্ষণে ভারতীয় সমর্থকদের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ার কথা। বৈশ্বিক আসরে ভারত, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে খেলেছে—এমন কোনো টুর্নামেন্টেই শিরোপা জিততে পারেনি ভারত।
ভারতীয় সমর্থকদের কি আবারও স্তব্ধ করে দেবে অস্ট্রেলিয়া?ছবি: রয়টার্স
২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই চার দল শেষ চারে খেললেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি তো এখনো তাজা। আহমেদাবাদের নীল সমুদ্রকে স্তব্ধ করে দিয়ে হলুদ উৎসব করেছিল অস্ট্রেলিয়ানরাই।
এবার কী হবে, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। ভারতীয় সমর্থকেরা এবার নিশ্চয় ‘সেইম সেইম’ নয়, ‘ডিফারেন্ট স্টোরি’ দেখতে চাইবেন!