চট্টগ্রামের খাল–নালায় পড়ে কেন এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 20-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

নিখোঁজ হওয়ার ১৪ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে নগরের চাক্তাই খাল থেকে উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ থাকা শিশু সেহরিশের নিথর দেহ। আগের দিন শুক্রবার রাত আটটার দিকে কাপাসগোলার হিজড়া খালে তলিয়ে যায় সে। এরপর শুরু হয় ‘উদ্ধারযজ্ঞ’। সিটি করপোরেশনের টনক নড়ে। সরে যায় খালে জমে থাকা ময়লার স্তূপ। ডুবুরিরা তল্লাশি চালান। পরবর্তী সময়ে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের চাক্তাই খালে ভেসে ওঠে সেহরিশের মরদেহ। স্থানীয় এক ব্যক্তি উদ্ধার করে ডাঙায় তোলেন।

যে স্থানে সেহরিশ ও তার পরিবারকে বহন করা অটোরিকশা খালে পড়ে গিয়েছিল, গতকাল সেখানে দেওয়া হয়েছে বাঁশের বেষ্টনী। তবে এখনো নগরের অধিকাংশ খাল–নালা উন্মুক্ত আছে।

 

 

সেহরিশের মা সালমা বেগম ও বাবা মো. শহিদুল ইসলাম থাকেন চাক্তাই খাল লাগোয়া চামড়ার গুদাম এলাকায়। গত শুক্রবার দাদি ও মায়ের সঙ্গে সেহরিশ এসেছিল কাপাসগোলায় ফুফুর বাড়িতে। কাপাসগোলার হিজড়া খালের এক পাশে শহিদুল ইসলামের বোনের বাড়ি। ওই বাড়িতে যেতে যে ছোট সড়ক ব্যবহার করতে হয় তার সঙ্গে লাগোয়া খালটি। তাঁরা সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। ছোট সড়কের মোড় ঘুরতে গিয়ে অটোরিকশাটি উল্টে খালে পড়ে যায়। দুজন উঠে আসতে পারলেও স্রোতে ভেসে যায় শিশুটি।

 

সেহরিশের মৃত্যুর ঘটনার পর খাল-নালা নিরাপদ করার প্রসঙ্গটি আবার সামনে এসেছে। সরকারি সংস্থাগুলো দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে না বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। কাপাসগোলার বাসিন্দা মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে আর কত দিন। আর কত প্রাণ ঝরলে খালের পাশে বসবে নিরাপত্তাবেষ্টনী। প্রতিটির মৃত্যুর পর একই দাবি তুলতে হয়। কিছুদিন আলোচনা চলে। এরপর সব থেমে যায়। সিটি করপোরেশন কী করছে। তাদের টনক নড়বে কবে।

গত শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে কাপাসগোলায় যখন উদ্ধার অভিযান চলছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, হিজড়া খালের যে অংশে অটোরিকশাটি উল্টে গেছে, সেখানে আগে বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া ছিল। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে এটি সরানো হয়েছিল।

৬ বছরে গেল ১৪ প্রাণ

গত ছয় বছরে নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২ জন, ২০২১ সালে ৫, ২০২৩ সালে ৩, ২০২৪ সালে ৩ ও চলতি বছর ১ জন। ২০২০ সালের ২১ জুলাই নগরের মহেশখালে পড়ে মৃত্যু হয় মুন্নি আক্তার ও ঝুমা আক্তার নামের দুই কিশোরীর।

২০২১ সালের ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। তাঁর মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। এরপর ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজারগেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার।

২০২২ সালে খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকার একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৬ ঘণ্টা পর নালার আবর্জনার নিচ থেকে ইয়াছিনের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামি হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)। এ ছাড়া ১ সেপ্টেম্বর বাদশা মিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় খালে পড়ে নিখোঁজ হয় মো. আবদুল্লাহ। শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয় সিডিএ আবাসিক এলাকার খাল থেকে।

২০২৪ সালের ২৭ মে আছদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে মৃত্যু হয় আজিজুল হাকিমের। ১১ জুন বিকেলে চাক্তাই খালের স্লুইসগেট-সংলগ্ন এলাকায় নিখোঁজ হয় অজ্ঞাতনামা এক শিশু। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর তার লাশ পাওয়া যায় পাশের রাজাখালী খালে। ৯ জুন আগ্রাবাদ এলাকার নাসির খালে পড়ে মারা যায় সাইদুল ইসলাম নামের সাত বছর বয়সী এক শিশু।

এখনো অরক্ষিত খাল-নালা

বারবার মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এখনো খাল ও নালার অনেক অংশ উন্মুক্ত। আবার কোথাও কোথাও বসেছে নিরাপত্তাবেষ্টনী, স্ল্যাব। গতকাল মোটরসাইকেলে নগরে চশমাখাল, মির্জাখাল, হিজড়া খাল, চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও বাঁশ দিয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসানো হয়েছে। কোথাও খালি পড়ে আছে। শিশু সেহরিশ যে অংশে নিখোঁজ হয়েছিল, সেখানে অবশ্য গতকাল সকালে বাঁশ দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া হয়। আবার মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, চকবাজার, ২ নম্বর গেট, মেয়র গলি, আল ফালাহ গলি, মেহেদিবাগ, বাকলিয়া ঘুরে দেখা গেছে, নালার ওপর কোথাও স্ল্যাব আছে, কোথাও নেই।

সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডে খাল-নালা রয়েছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। খালের সংখ্যা ৫৭। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালে কাজ চলছে।

অরক্ষিত খাল-নালায় নিরাপত্তাবেষ্টনী ও স্ল্যাব বসানো হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। গতকাল গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ৩৬টি খালের বিভিন্ন অংশে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। আরও যেখানে প্রয়োজন, সেখানে স্থাপন করা হবে।

 

বহদ্দারহাট মোড়ে গিয়ে কথা হয় পথচারী ইকবাল হায়দারের সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী ইকবাল বলেন, নগরের খাল-নালাগুলোর বর্ষার সময় ফুলেফেঁপে ওঠে। অনেক সড়ক ও খাল পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে কোনটি খাল, কোনটি সড়ক তা বোঝার উপায় থাকে না। এতে ঘটে দুর্ঘটনা।

খাল-নালা ঝুঁকিমুক্ত না হওয়ার জন্য সিডিএ-সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, খাল-নালা নিরাপদ করার দায়িত্ব প্রধানত সিটি করপোরেশন ও সিডিএর। উন্মুক্ত নালা-খালে নিরাপত্তাবেষ্টনী বসাতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো হয়েছে, কিন্তু আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এ বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী দিতে হবে।

শেয়ার করুন