ঠিকাদারদের লাইসেন্স আটকে রেখে ৯ কোটি টাকার কাজ ভাগাভাগির অভিযোগ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 11-11-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বগুড়ার সোনাতলা পৌরসভার পাকা ড্রেন এবং আরসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণের সাতটি প্যাকেজের প্রায় ৯ কোটি টাকার দরপত্রের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাধারণ ঠিকাদারদের লাইসেন্স কৌশলে আটকে রেখে সোনাতলা উপজেলা ও পৌর বিএনপি এবং যুবদলের একাংশের নেতারা এই দরপত্রে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা সবাই উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহসানুল তৈয়বের (জাকির) স্বজন ও অনুসারী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সোনাতলা পৌরসভা সূত্র জানায়, সাতটি কাজের জন্য সোনাতলা পৌরসভার প্রকৌশল শাখা থেকে সাতটি প্যাকেজে ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হয়। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গতকাল রোববার (১০ নভেম্বর) দরপত্র কেনার এবং আজ সোমবার (১১ নভেম্বর) ছিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। শেষ পর্যন্ত সাতজন ঠিকাদার এই দরপত্রে অংশ নিয়েছেন।

 

এ সাতটি কাজ হলো সোনাতলা পৌর এলাকার বিশুপাড়া থেকে প্রতিবন্ধী স্কুল পর্যন্ত ৩০০ মিটার আরসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণ; গড়ফতেপুর জিল্লুর রহমানের বাড়ি থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ৩৭৫ মিটার আরসিসিসি রাস্তা এবং গড়ফতেপুর রতনের বাড়ি থেকে আহলে মসজিদ পর্যন্ত আরসিসি রাস্তা নির্মাণ; সোনাতলা পৌর এলাকার চমরগাছা বরেন্দ্র গভীর নলকূপ থেকে বাঙ্গারহাট রোড পর্যন্ত ৫০০ মিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণ; চমরগাছা মসজিদ থেকে কলাগাছিপাড়া ৫৩০ মিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণ; কামারপাড়া শরীফ উদ্দিন রেলগেট থেকে কামারপাড়া মসজিদ পর্যন্ত ৪৬০ মিটার আরসিসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণ; কামারপাড়া ওয়াক্ত মসজিদ থেকে পৌরসভার শেষ সীমানা পর্যন্ত ৫৫০ মিটার আরসিসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণ এবং ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন মোড় থেকে বিশুপাড়া রেল গুমটি পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে ১ হাজার ৫০ মিটার আরসিসি ঢালাই ড্রেন নির্মাণ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পৌরসভার প্রশাসক স্বীকৃতি প্রামানিক প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স আটকে রাখার বিষয়ে পৌরসভার একজন ঠিকাদার অভিযোগ করেছিলেন। তাৎক্ষণিক তাঁকে লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লাইসেন্স আটকে রেখে দরপত্র কেনা বা দাখিলে বাধা দেওয়ার বিষয়ে অন্য কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দরপত্র বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে।

কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, সাতটি কাজের জন্য পৌরসভার তালিকাভুক্ত প্রায় ৪৬ জন ঠিকাদার দরপত্র কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করার পরপরই নবায়নের জন্য কৌশলে সাধারণ ঠিকাদারদের লাইসেন্স পৌরসভার সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিতে বলা হয়। এরপর ৩৯ জন সাধারণ ঠিকাদারের লাইসেন্স প্রথমে পৌরসভার প্রকৌশল শাখা আটকে রেখে বাকি ৭ জন ঠিকাদারের নামে ৯ কোটি টাকার কাজ বিএনপির নেতাদের মাঝে ভাগাভাগির চেষ্টা করা হয়। লাইসেন্স আটকে রেখে কাজ ভাগাভাগির বিষয়টি বিএনপি-সমর্থিত একাধিক ঠিকাদার পৌরসভার প্রশাসককে জানান। এরপর পৌরসভা কার্যালয়ে নবায়নের জন্য জমা দেওয়া লাইসেন্স জোর করে কবজায় নেন সোনাতলা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও পৌর যুবদলের আহ্বায়ক হারুন উর রশিদ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি–সমর্থিত সাবেক কাউন্সিলর জাফর ইকবাল (চপল)। তাঁরা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহসানুল তৈয়বের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে পরিচিত। লাইসেন্স জিম্মি থাকায় সাধারণ ঠিকাদারেরা দরপত্রে অংশ নিতে পারেননি।

 

বগুড়ার বিএনপি–সমর্থিত একজন ঠিকাদার অভিযোগে বলেন, তিনি সাতটি কাজের দরপত্র কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু নবায়নের নামে সোনাতলা পৌরসভা আগেই লাইসেন্স জমা নেয়। এরপর আহসানুল তৈয়বের অনুসারী নেতা–কর্মীরা ‘কমান্ডো স্টাইলে’ সাধারণ ঠিকাদারদের সবগুলো লাইসেন্স কবজায় নিয়ে দরপত্রে অংশগ্রহণ না করার জন্য হুমকি দেন। আহসানুল তৈয়বের কথা বলে তাঁরা দরপত্রে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়ায় কেউ আর এ নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি, দরপত্রে অংশগ্রহণও করতে পারেননি। ঠিকাদারেরা আজ রোববার পর্যন্ত লাইসেন্সও ফিরে পাননি।

অভিযোগের বিষয়ে পৌর যুবদলের আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ঠিকাদারের লাইসেন্স আটকে রেখেছি, এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

বিএনপি নেতাদের একাংশের অভিযোগ, সাধারণ ঠিকাদারেরা অংশগ্রহণ করতে না পারায় পৌরসভার সাতটি কাজ নামে-বেনামে আহসানুল তৈয়বের লোকজনের মধ্যে ভাগাভাগি হতে যাচ্ছে। এই তালিকায় আছেন আহসানুলের ছোট ভাই ও উপজেলা জিয়া পরিষদের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম, তাঁর বড় ভাই ও উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আহসানুল হাবিব, ভাগনে আহসান হাবিব রতন, আহসানুল তৈয়বের অনুসারী উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজ্জাকুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিয়াউল করিমের ভাই টফি এবং আওয়ামী লীগ–সমর্থিত সাবেক পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

বিএনপি–সমর্থিত ঠিকাদার কামরুজ্জামান বলেন, ‘আহসানুল তৈয়বের অনুসারীরা তদবির করে বরাদ্দ নিয়ে আসায় মোট প্রাক্কলিত মূল্যের ৫ শতাংশ সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে, ৫ শতাংশ অফিস খরচ এবং ম্যানেজ বাবদ ৩ শতাংশ ঠিকাদারদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শুনেছি।’

জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আহসানুল তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ঠিকাদার প্রমাণ দিতে পারবে না কাউকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমি কোনো দলীয় প্রভাব বিস্তার করেছি বা দরপত্র কিনতে ও দাখিল করতে বাধা দিয়েছি। আমার ভাই-ভাগনে দরপত্রের কাজ পেয়েছে কি না, সেটাও আমার জানা নেই।’ তিনি বলেন, উপজেলা বিএনপি ও যুবদলের একাংশ তাঁকে অপছন্দ করেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁকে হেয় করতে এবং সুনাম নষ্ট করতে ৯ কোটি টাকার কাজ ভাগাভাগির অপ্রচার চালাতে পারেন।

সোনাতলা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনাতলা পৌরসভার ৯ কোটি টাকার এ কাজ বাগাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহসানুল তৈয়ব নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন। কাজ ভাগাভাগিতে পৌরসভার প্রশাসক এবং পৌরসভার প্রকৌশলীসহ অন্যরাও সহযোগিতা করেছেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, সোনাতলায় এখনো টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সবকিছুই চলছে বিএনপির একজন নেতার ইশারায়। দলীয় ঠিকাদারদের বঞ্চিত করে সবশেষ পৌরসভার ৯ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ উপজেলা বিএনপির সভাপতির ইচ্ছায় তাঁর ভাই, ভাগনে, আত্মীয়স্বজনসহ অনুসারীদের মাঝে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে। শুধু আত্মীয় হওয়ার কারণে সোনাতলা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শ্রমিক লীগের নেতা জাহাঙ্গীর আলমকেও বেনামে (জুলফিকার রহমান) একটি কাজ দেওয়া হয়েছে।

সোনাতলা পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মো. আবু শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথভাবে নিয়ম অনুসরণ করেই দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পৌরসভায় কোনো ঠিকাদারের লাইসেন্স আটকে রাখা হয়নি।

শেয়ার করুন