রায়পুরায় আধিপত্য নিয়ে দুই গোষ্ঠীর ২৫ বছরের দ্বন্দ্ব থেকে জোড়া খুন
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 08-12-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

নরসিংদীর রায়পুরায় জোড়া খুনের কারণ হিসেবে সামনে এসেছে দুই গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তার এবং তাদের প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব। উপজেলার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের মেথিকান্দা এলাকায় দ্বন্দ্বে লিপ্ত পক্ষ দুটি হলো আবিদ আসান (রুবেল) গোষ্ঠী ও আবদুল বাছেদ গোষ্ঠী। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য ২৫ বছর ধরে চলে আসা দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গতকাল শনিবার ভোর থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত উপজেলার মেথিকান্দা এলাকায় আবিদ হাসান ও আবদুল বাছেদ গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে উপজেলার চান্দেরকান্দি ইউপির সদস্য মানিক মিয়া (৫৫) ও সাবেক সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য কল্পনা বেগম (৩২) নিহত হন। মানিক মিয়ার বাম পা হাঁটুর ওপর থেকে কুপিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন দুই গোষ্ঠীর অন্তত ১০ জন।

 

জোড়া খুনের ঘটনা এর মধ্যে ৩৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আজ রোববার বেলা দুইটা পর্যন্ত কেউ মামলা করতে থানায় যাননি। টেঁটাসহ বেশকিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করলেও এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জব্বার আরও জানান, নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে নিহত দুজনের লাশের ময়নাতদন্ত চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করা হবে। হয়তো জানাজা ও দাফন শেষে তাঁরা মামলা করতে থানায় আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরো এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুই গোষ্ঠীর সব পুরুষেরা বর্তমানে এলাকাছাড়া। জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রের ভাষ্য, গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বাছেদ পক্ষের লোকজন অতর্কিত হামলা চালায় রুবেল পক্ষের লোকজনের ওপর। সংঘর্ষের সময় রুবেলের চাচা ইউপি সদস্য মানিক মিয়া চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বশির উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় তাঁকে বশির উদ্দিনের উঠানে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত মানিক মিয়া চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। পরে সাবেক নারী ইউপি সদস্য কল্পনা বেগমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় রুবেল পক্ষের লোকজন পাল্টা গুলি চালালে গোলাগুলিতে অন্তত ১০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ আশেপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

 

ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই প্রতিবেদক দুই গোষ্ঠীর লোকজন, পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। সবার ভাষ্য, মূলত প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। গোষ্ঠী দুটির দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২৫ বছর আগে, আবিদ হাসানের চাচা কামাল হোসেনকে রেললাইনে কুপিয়ে হত্যার পর থেকে। বাছেদ গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে ওই হত্যা মামলা এখনো আদালতে চলমান। দুই গোষ্ঠীর নেতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও সাবেক সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদের আনুকূল্য পেয়ে আবিদ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছিলেন।

তবে ঝামেলা বাঁধে রায়পুরা উপজেলা নির্বাচনে (পরবর্তী সময়ে স্থগিত) আবিদ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হলে। অপর ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়াকে সমর্থন দেন সাবেক সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদ। সুমনকে সমর্থন দেয় বাছেদের গোষ্ঠীর লোকজনও। একপর্যায়ে চরাঞ্চলে গণসংযোগের সময় সুমন মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবিদ হাসান এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় করা মামলায় আবিদকে আসামি করা হলে বেশ কিছু দিন তিনি পলাতক ছিলেন। ৫ আগস্টের পর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন আবিদ। সুমন হত্যাকাণ্ডের পর থেকে দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব আবার সামনে আসে। আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠে তারা। একের পর এক ঘটাতে থাকে নানা ঘটনা।

গত ১৩ আগস্ট দুপুরে রায়পুরা পৌরসভার শ্রীরামপুর রেলগেটে জনসমক্ষে আবদুল বাছেদের ভাতিজা ও দৈনিক দেশ রূপান্তরের রায়পুরা প্রতিনিধি মনিরুজ্জামানকে সড়কে ফেলে পায়ে গুলি করার অভিযোগ উঠে আবিদ হাসানের লোকজনের বিরুদ্ধে। এর আগে ১১ আগস্ট সকালে আবিদ হাসানের বড় ভাই রেজাউল করিমের ছেলে আবির ইসলামকে (১১) পায়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছিল বাছেদ গোষ্ঠীর লোকজন। তাঁর যে পায়ে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছিল, প্রতিশোধ নিতে বাছেদের লোকজন মনিরুজ্জামানের সে পায়েই গুলি করেছিল।

১৭ অক্টোবর বিকেলে বাছেদ গোষ্ঠীর জাহাঙ্গীর আলম (দুলাল) নামের একজন পোস্টাল ম্যানেজারকে বাড়ি ফেরার সময় ওই শ্রীরামপুর বাজারের সড়কে ফেলে গাছ কাটার করাত দিয়ে বাম পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে দেয় আবিদ হাসানের লোকেরা। এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে শনিবার সংঘর্ষের সময় আবিদ হাসানের চাচা ইউপি সদস্য মানিক মিয়ার বাম পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে কেটে দেয় বাছেদ গোষ্ঠীর লোকেরা। এ ছাড়াও তাঁদের গুলিতে নিহত হন আবিদ হাসানের ফুফু কল্পনা বেগম।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে দুই গোষ্ঠীর প্রধান আবিদ হাসান ও আবদুল বাছেদের ব্যবহৃত মুঠোফোন নাম্বারে একাধিকবার কল দেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরের সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জব্বার জানান, মূলত প্রতিশোধস্পৃহা এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতেই দুই গোষ্ঠী একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। ৫ আগস্টের আগে এলাকায় আধিপত্য ছিল আবিদ হাসানের। এখন আবদুল বাছেদ আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছেন। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তাঁরা এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে নিয়মিত পুলিশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন, তাই তাঁদের সহজে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না।

 


 

শেয়ার করুন