টাকা জমা দেওয়া আছে। পরীক্ষাও শেষ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাজ বাকি শুধু একটি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড প্রিন্ট করে গ্রাহককে দেওয়া। এই সাধারণ কাজটিই করতে পারছে না সরকারি এই সংস্থা। ফলে সোয়া ছয় লাখের বেশি মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছেন। কারও কারও অপেক্ষা তিন বছরের।
মানুষের এই ভোগান্তি তৈরি হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আমলে। অভিযোগ রয়েছে, তখন পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার কারণে জটিলতা তৈরি হয়। সেই থেকে ভুগছেন মানুষ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড ব্যবস্থাই তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বদলে দেওয়া হবে সাধারণ মানের প্লাস্টিকের পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) কার্ড।
মানুষের এই ভোগান্তি তৈরি হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আমলে। অভিযোগ রয়েছে, তখন পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার কারণে জটিলতা তৈরি হয়। সেই থেকে ভুগছেন মানুষ।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, পিভিসি কার্ড দেওয়া হবে নতুন আবেদনকারীদের। পুরোনো আবেদনকারীদের আগের কার্ডই দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কবে তাঁরা কার্ড পাবেন, সেই নিশ্চয়তা নেই।
বিআরটিএ
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহসানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো ঠিকাদার কার্ড এনেছেন বলে জানিয়েছেন। ধীরে ধীরে জটিলতা কেটে যাবে। তিনি বলেন, পিভিসি কার্ড চালুর মূল লক্ষ্য দ্রুত প্রিন্ট করা যায়। এতে মানুষের ভোগান্তি কমবে। তবে এই কার্ডেও কিউআর কোড থাকবে, যা দিয়ে পথে লাইসেন্সের সঠিকতা যাচাই করা যাবে।
সংস্থাটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন সরকার যদি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে গণ-অভ্যুত্থানটি শুধু একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হিসেবে গণ্য হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
স্মার্টকার্ড যথাসময়ে দিতে না পেরে বিআরটিএ গ্রাহককে একটি কাগুজে লাইসেন্স দিচ্ছে। সেটা দেখালে ট্রাফিক পুলিশ আইনি ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য সবচেয়ে ভোগান্তিতে আছেন লাইসেন্স নিয়ে বিদেশে কর্মী হিসেবে যেতে আগ্রহীরা। কারণ, স্মার্টকার্ড ছাড়া তাঁরা বিদেশ যেতে পারছেন না।
সৌদি আরবের ভিসা নিয়ে বসে আছেন কুমিল্লার আবদুল মতিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর লাইসেন্সটি সংশোধন করা দরকার। এ জন্য দালালের মাধ্যমে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন করেছেন। তিনি বলেন, কার্ডটি প্রিন্টিংয়ের (ছাপা) অপেক্ষায়। এভাবে দুই মাস কেটে গেছে। লাইসেন্স পেলেই দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দেবেন।
সূত্র বলছে, এখন অল্প অল্প কার্ড এনে প্রভাবশালী আমলা ও বিদেশগামীদের দেওয়া হয়। এ জন্য বিআরটিএর চেয়ারম্যানের দপ্তরে ভিসা দেখিয়ে তালিকাভুক্ত হতে হয় বিদেশগামীদের। তবে এই তথ্য অনেকেই জানেন না। যাঁরা জানেন, তাঁদের বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের স্থানীয় কর্মী ও বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা সংকটের সুযোগ নিয়ে বাড়তি টাকা নিয়ে কিছু কিছু লাইসেন্স প্রিন্ট করছে।
ঢাকার পল্টনের একটি ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফুজায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেওয়া অনেকেই লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কেউ কেউ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স সংগ্রহ করেছেন।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, পিভিসি কার্ড দেওয়া হবে নতুন আবেদনকারীদের। পুরোনো আবেদনকারীদের আগের কার্ডই দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কবে তাঁরা কার্ড পাবেন, সেই নিশ্চয়তা নেই।
দেশে যানবাহনচালকের লাইসেন্স দেয় বিআরটিএ। সংস্থাটি সব লাইসেন্সধারী চালকের তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ করে। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে লাইসেন্স দেওয়া ও তথ্যভান্ডার সংরক্ষণের কাজ ঠিকঠাকভাবে করতে পারছে না সংস্থাটি।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সংকট শুরু হয়েছিল মূলত পছন্দের ঠিকাদারকে কার্ড ছাপানোর কাজ দেওয়াকে কেন্দ্র করে। ঠিকাদারটির নাম ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তৎপর ছিলেন সড়ক মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর তখনকার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।
মাদ্রাজ প্রিন্টার্সকে কাজ দেওয়ার সময় সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব ছিলেন নজরুল ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হলে তাঁর দুটি মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। ২০২০ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত বিআরটিএর চেয়ারম্যান ছিলেন নূর মোহাম্মদ মজুমদার। বারবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
আগের ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০১৯ সালে পরবর্তী পাঁচ বছরে ৩৫ লাখ স্মার্টকার্ড লাইসেন্স সরবরাহের জন্য নতুন দরপত্র আহ্বান করে বিআরটিএ। দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন ও কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ফ্রান্সের সেল্প কার্ডস সলিউশন, ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এবং মালয়েশিয়ার পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনাল। বিআরটিএ সূত্র জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা হয় সেল্প সলিউশন। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা মাদ্রাজ প্রিন্টার্স। পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনাল তৃতীয় হয়।
স্মার্টকার্ড যথাসময়ে দিতে না পেরে বিআরটিএ গ্রাহককে একটি কাগুজে লাইসেন্স দিচ্ছে। সেটা দেখালে ট্রাফিক পুলিশ আইনি ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য সবচেয়ে ভোগান্তিতে আছেন লাইসেন্স নিয়ে বিদেশে কর্মী হিসেবে যেতে আগ্রহীরা। কারণ, স্মার্টকার্ড ছাড়া তাঁরা বিদেশ যেতে পারছেন না।
দরপত্র মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স বিআরটিএ ও সড়ক মন্ত্রণালয়ে তিন দফা অভিযোগ করে জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা সেল্প সলিউশনের আইএসও (আন্তর্জাতিক মান সংস্থা) সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে দরপত্র বাতিল করে দেয় সড়ক মন্ত্রণালয়।
২০২০ সালে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং লাইসেন্স সরবরাহের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৪০ লাখ। দ্বিতীয় দফার দরপত্রে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পান আগের তিন ঠিকাদারই। যদিও এবার সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মাদ্রাজ প্রিন্টার্স। তারা প্রতিটি স্মার্টকার্ডের দর প্রস্তাব করেছিল ৩০০ টাকা ৬৬ পয়সা। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা সেল্প সলিউশনের দর ছিল ৩৩১ টাকা ১৫ পয়সা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ২৯ জুলাই মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিআরটিএ। প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ পায় ওই বছরের সেপ্টেম্বরে। তিন মাসের মধ্যে লাইসেন্স সরবরাহ শুরু করার কথা তাদের। যদিও তারা আরও ছয় মাস পর কার্ড দেওয়া শুরু করে। ঠিকাদার নিয়োগে দেরি এবং নতুন ঠিকাদার কার্ড সরবরাহ শুরু করতে বিলম্ব করায় গ্রাহকের আবেদন জমতে থাকে।
ঠিকাদারি কাজ পাওয়া মাদ্রাজ প্রিন্টার্স চাহিদা অনুযায়ী কার্ড দিতে পারেনি। অজুহাত হিসেবে তারা কখনো করোনা মহামারি, কখনো ঋণপত্র খোলায় জটিলতার বিষয়টি সামনে এনেছে। অন্যদিকে আবেদনকারীদের ভোগান্তি বেড়েছে।
চুক্তির দিন থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ৪০ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের। তবে এখন পর্যন্ত তারা ২০ লাখের মতো কার্ড সরবরাহ করেছে। সোয়া ছয় লাখ গ্রাহকের তথ্য নিয়েও তারা কার্ড দিতে পারেনি। প্রতিদিনই নতুন নতুন আবেদন যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন, পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন ও সংশোধন রয়েছে।
মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের ব্যবস্থাপক আহমেদ কানী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বিআরটিএ সময়মতো বিল দিচ্ছে না। এ জন্য কার্ড আমদানি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অনেকে সময়মতো লাইসেন্স পাচ্ছে না।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাস প্রিন্টার্সের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। ঠিকাদার পণ্য সরবরাহ করার পর তাদের টাকা দেওয়ার কথা। এর বাইরে চুক্তির শর্ত অনুসারে অন্যান্য যন্ত্রপাতি, স্থাপনা এবং লোকবল নিয়োগ দেওয়ার কথা। সেটা মাদ্রাজ প্রিন্টার্স ঠিকমতো করেনি। তারা যতটুকু কাজ করেছে, তার বিল দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, উন্নত বিশ্বের সব দেশেই চালকের লাইসেন্স স্মার্টকার্ড হয়ে থাকে। এমনকি আশপাশের দেশগুলোতেও এখন আর পিভিসি কার্ড দেওয়া হয় না। ২০১১ সালে স্মার্টকার্ড চালু হয়েছিল। এখন আবার প্লাস্টিক কার্ডে ফেরত যাওয়া হচ্ছে।
চুক্তির দিন থেকে শুরু করে ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ৪০ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের। তবে এখন পর্যন্ত তারা ২০ লাখের মতো কার্ড সরবরাহ করেছে। সোয়া ছয় লাখ গ্রাহকের তথ্য নিয়েও তারা কার্ড দিতে পারেনি। প্রতিদিনই নতুন নতুন আবেদন যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন, পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন ও সংশোধন রয়েছে।
বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রবল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২১ সালে একটি জরিপে জানিয়েছিল, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয় ৮৩ দশমিক ১ শতাংশ খানা (পরিবার)। ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার সেবা নিয়েছে দালাল বা অন্য কোনো মাধ্যমে।
সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ১৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, লাইসেন্সের ক্ষেত্রে তিনিও ভুক্তভোগী। তাঁর গাড়ির চালককে লাইসেন্স করাতে সাতবার ছুটি নিতে হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ একটি কার্ড দিতে এই অযোগ্যতা রোগের লক্ষণ। রোগটি হলো যোগসাজশের মাধ্যমে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের সময় সেই জবাবদিহি ছিল না।
বাংলাদেশে সড়ক খাতে অব্যবস্থাপনার একটি বড় কারণ বিআরটিএ বলে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্থাটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন সরকার যদি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে গণ-অভ্যুত্থানটি শুধু একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হিসেবে গণ্য হবে।