যাতায়াত খরচ জোগাড় করতে ছুটিতে বাড়িতে এসে গ্রামের বাজারে ডিম বিক্রি করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মেরিগাছা বাজারে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি খোলা আকাশের নিচে বসে তাঁর সিদ্ধ ও কাচা ডিম বিক্রির দৃশ্য দেখে অনেকে ছবি তুলছেন। ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন। এতে বিরক্ত না হয়ে একমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন ওই শিক্ষার্থী।
ওই শিক্ষার্থীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পা (২১)। তাঁকে পড়ালেখা করানোর পেছনে ভ্যানচালক বাবার চাপ কমানোর জন্যই তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। জান্নাতুল উপজেলার নগর ইউনিয়নের দোগাছি গ্রামের আবদুর রহিমের মেয়ে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁর বাবা একজন ভ্যানচালক। বাবা সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কোনো রকমে তাঁর পড়ালেখার খরচ জোগান। খাওয়ার খরচের বাইরে কোনো টাকা অবশিষ্ট থাকে না। এ কারণে স্বল্প সময়ের ছুটিতে তিনি বাড়িতে আসেন না। এবার প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ১৫ দিনের ছুটি কাটাতে ২৩ জানুয়ারি তিনি বাড়িতে এসেছেন। আসতে আসতে ভেবেছেন, যাতায়াতের টাকাটা তিনি গ্রামে ডিম বিক্রি করে জোগাড় করবেন। সেই ভাবনা থেকে তিনি প্রতিদিন বিকেলে বাবার ভ্যানে চড়ে মেরিগাছা বাজারে আসেন। সেখানে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে টুলে বসে সেদ্ধ ও কাঁচা ডিম বিক্রি করেন।
জান্নাতুল বলেন, দ্রুত একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে প্রথমেই তাঁর মাথায় আসে ডিম বিক্রির ভাবনা। স্থানীয় বনপাড়ার আড়ত থেকে ডিম কিনে আনেন তিনি। প্রতিটি সেদ্ধ ডিম তিনি বিক্রি করেন ১৫ টাকা করে। তবে দুইটা এক সঙ্গে নিলে ২৫ টাকায় দেন। কাঁচা ডিম বিক্রি করেন প্রতি হালি ৪২ টাকায়। অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে ডিম বিক্রি করেন। তবে পরিমাণে অন্যদের চেয়ে বেশি ডিম বিক্রি করতে পারেন। প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ ডিম বিক্রি হয় তাঁর। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন। সে পর্যন্ত ডিম বিক্রি অব্যাহত রাখতে চান। প্রতিদিন গড়ে ৭০০ টাকা উপার্জন হচ্ছে ডিম বিক্রি করে। এতে যাতায়াত খরচ মিটিয়ে কিছু হাতখরচও করতে পারবেন।
ভ্যানচালক বাবার চাপ কমানোর জন্যই জান্নাতুল ডিম বিক্রি করে যাতায়াত ও হাতখরচ জোগাড়ের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। মঙ্গলবার নাটোরের বড়াইগ্রামের মেরিগাছা বাজারে
জান্নাতুলের ডিম বিক্রির দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করছেন। কায়েস উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, ‘কোনো কাজই যে ছোট না, এই সচেতন শিক্ষার্থী তারই উদাহরণ। আমরা এর থেকে শিক্ষা নিতে পারি।’ নওশিন তাবাচ্ছুম আইশা লিখেছেন, ‘এটা একটা চমৎকার কাজ।’ তবে দুই-একজন তির্যক মন্তব্যও করেছেন। যেমন মো. ইকবাল লিখেছেন ‘ভাইরাল রোগে ধরছে’।
এ ব্যাপারে জান্নাতুলের ভাষ্য, ‘অনেকেই অনেক কথা বলতে পারে। এতে কিছু যায় আসে না। আমি সৎভাবে উপার্জন করছি। নিজেকে আমি একজন অতি ক্ষুদ্র ও গরিব উদ্যোক্তা মনে করছি।’ এই বিশ্ববিদ্যায়শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্থানীয় খলিসাডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর খুব চিন্তাই পড়েছিলাম, হয়তো এখানেই থেমে যাবে আমার লেখাপড়া। কারণ, গরিব মা–বাবা হয়তো আমাকে আর পড়াবেন না। কিন্তু আমি থেমে যাইনি। আমার ইচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করব।’
জান্নাতুলের বাবা আবদুর রাহিম বলেন, ‘আমার ভ্যানে করেই আমি আমার মেয়েকে এই বাজারে নিয়ে আসি ও নিয়ে যাই। সে অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ছুটিতে এসে সে এই ডিম বিক্রি করছে আমার প্রতি মায়া করে। যাওয়ার সময় অনেক টাকা ভাড়া লাগে। সেই ভাড়া জোগাড় করতেই সে ডিম বিক্রি করছে। ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন, সে যোগ্য ও সৎ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে।’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা সাহেব জানান, ‘টুম্পা স্কুলজীবন থেকেই সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। সে অনেক মেধাবী। ছুটিতে বাড়িতে এসে ডিম বিক্রির এই কাজ সবার জন্য অনুপ্রেরণামূলক।’