আঁটসাঁট ইজিবাইকটায় চারজনের ব্যাগপত্তর দিয়েই ভরে গেল। তারপর আমাদের বসতে হলো বেশ কায়দা করে। এর মধ্যেই জটলা ঠেলে সামনে এগোতে থাকল ইজিবাইকটা। জেটিতে জাহাজ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেন্ট মার্টিনের এই জেটিঘাটের রূপ বদলে যায়। ইজিবাইক আর ভ্যানচালকদের হাঁকডাকে কান পাতা দায় হয়ে যায় তখন। অবশ্য জটলা পার হতেই স্বস্তি মিলল। সিমেন্ট-সুরকির ঢালাইয়ের সরু সড়ক ধরেই শাঁ শাঁ করে ছুটে চলল তিন চাকার বাহনটি।
আমরা যাচ্ছি সেন্ট মার্টিনের পূর্ব পাড়ায়। সেখানকার একটি রিসোর্টে থাকব। যেতে যেতেই ইজিবাইকচালকের সঙ্গে টুকটাক আলাপ। বয়স্ক মানুষটা হাসিমুখে আমাদের অপ্রাসঙ্গিক নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। পথের ধারে, দোকানে বসে থাকা মানুষও হাঁক ছেড়ে, কখনো ইশারায় তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। মনে হচ্ছিল, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সব মানুষই বুঝি তাঁকে চেনে। চিনতেও পারে, ছোট দ্বীপ, একজন আরেকজনকে চিনবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
সেন্ট মার্টিনের মানুষ নাজির আহমদছবি: লেখক
অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। প্রতিদিন জাহাজ আসছেও। কিন্তু সপ্তাহখানেক পার হলেও পর্যটকের আনাগোনা তেমন একটা নেই। আমরা অবশ্য উপচে পড়া পর্যটকহীন সেন্ট মার্টিন দেখব বলেই মৌসুমের শুরুতে চলে এসেছি। আসার আগে হিসাব–নিকাশ করে সপ্তাহের ছুটির দিনও এড়িয়ে এসেছি। এতে আরও ফাঁকা সেন্ট মার্টিনের দেখা পেলাম।
তবে ফাঁকা সেন্ট মার্টিনেও কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল হাতুড়ি-বাটালির শব্দ। ইজিবাইকের চালক সেই শব্দের রহস্য জানালেন, অধিকাংশ হোটেল-রিসোর্ট বছরের লম্বা সময় বন্ধ থাকে। তাই প্রতিবছর মেরামত করতে হয়। তারই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।
এসব আলাপ করতে করেতই ইজিবাইক থেমে গেল। চালক হাসিমুখে বললেন, রিসোর্টে যেতে আমাদের এখানেই নামতে হবে। রাস্তার শেষ মাথা এটি। সামনেই ধানখেত। তারপর একচালা তিনটি ঘর নিয়ে একটা বাড়ি। বাড়ি ওপাশ থেকে সৈকতে ঢেউ ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে। কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় চালক জানালেন, এই বাড়ির ভেতর দিয়ে রিসোর্টে যেতে হবে।
পর্যটন মৌসুমে অনেকেই সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যানছবি: লেখক
এত ব্যাগপত্তর নিয়ে অচেনা একটা বাড়ির ভেতর দিয়ে যাব কীভাবে! রিসোর্টে কল করতেই মুশকিল আসান! তারা জানাল, আমরা যেন অপেক্ষা করি, তারা লোক পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে।
অপেক্ষা করতে করতেই ইজিবাইকচালকের সঙ্গে আলাপ। নাম তাঁর নাজির আহমদ। পর্যটন মৌসুমে ইজিবাইক চালান। অন্য সময় তেমন কাজ থাকে না। তাঁর পূর্বপুরুষেরা অনেক আগে এই দ্বীপে এসেছিলেন। এখনো অনেক জমিজমা আছে তাঁর।
আলাপের মধ্যেই এক পথচারী এসে আমাদের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি নাজির আহমদকে ‘চেয়ারম্যান’ সম্বোধন করে কুশল জানতে চাইলেন। চেয়ারম্যান? আমার চোখেমুখে কৌতূহল বুঝতে পেরে নাজির আহমদ ব্যাপারটা খোলাসা করেন।
২০১২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন নাজির। ভেবেছিলেন, চেয়ারম্যান হয়ে দ্বীপের ভালো–মন্দ দেখবেন। কিন্তু আনারস মার্কায় তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ৫০০ ভোট। অর্থকড়ি খরচ করে ভোট না পাওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছিলেন তখন। সেই থেকে সেন্ট মার্টিনের ছেলে-বুড়োরা তাঁকে ‘নাজির চেয়ারম্যান’ নামে চেনে।
সেন্ট মার্টিনে আমাদের পরের দুটি দিন সঙ্গী ছিলেন এই নাজির ‘চেয়ারম্যান’।