পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করতে দ্রুতগতির ট্রেন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী ২০২৩ জুনে প্রথমবারের মতো ঢাকা-কক্সবাজার পথে রেল যোগাযোগ শুরুর আশা করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে রেলপথ বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় মাটির কাজ। সব মিলিয়ে ২৮ কিলোমিটার পথে বসেছে রেললাইন আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে রেললাইন নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শত বছরের পুরানো। ৯০ বছর আগে রেললাইন নির্মাণ করা হলেও তা দোহাজারীতে গিয়ে থেমে যায়। বর্তমান দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, সৈকত শহর কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা।
আগামী ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত মার্চ পর্যন্ত দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৭০ শতাংশ। ফলে ডিসেম্বরের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আগামী বছরের জুনে ট্রেন চালুর লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিরও প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে।
প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই পথে রেললাইন চালুর প্রাথমিক লক্ষ্য পর্যটক। তাই পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারে নির্মিত হচ্ছে দেশের আইকনিক রেলস্টেশন। কক্সবাজারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্টেশনটি হচ্ছে ‘ঝিনুকের’ আকৃতিতে।
এদিকে রামুর জোয়ারিয়ানালা এলাকায় সরজমিন দেখা যায়; তীব্র গরম, তারপরও থেমে নেই কর্মযজ্ঞ। শ্রমিকদের কাজের সময় সকাল ৮টা হলেও গরমের কারণে সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় কাজ। নির্ধারিত সময়ের আগে কাজে যোগ দিচ্ছেন শ্রমিকরা। পুরোদমে চলছে রেললাইনে ক্লিপিং, রাবার প্যাড ও লাইনার বসানোর কাজ।
প্রকল্পের প্রথম অংশ দোহাজারী থেকে চকরিয়া আর দ্বিতীয় অংশ চকরিয়া থেকে কক্সবাজার। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় অংশে ৫১ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে বসেছে ২৮ কিলোমিটার রেললাইন। এই রেললাইনে চলছে ক্লিপিং, রাবার প্যাড ও লাইনার বসানোর কাজ। একই সঙ্গে এগিয়ে চলছে ট্যাম্পিং, লেভেলিং ও প্যাকিংয়ের কাজ। আর মাটির কাজ হওয়ায় দ্রুত বসছে রেল ট্র্যাকও।
নির্মাণ শ্রমিক মোঃ ছাত্তার বলেন, একমাস আগেও সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতাম। কিন্তু গরমের কারণে এখন ভোর ৬টা থেকে কাজ শুরু হয়, যা শেষ করি বিকেল ৩টায়।’
সুপারভাইজার আব্দুস সামাদ বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে চার ধাপে কাজ চলছে। এখন ৪টি ধাপে বটমব্লাস্ট, স্লিপার রেল, ফ্লাশবার ওয়েলডিং, রাবার প্যাড, ইনস্লুডার, ক্লিপিং, ব্লাস্ট রেকিং, ট্যাম্পিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুতগতিতে কাজ চালানোর জন্য কক্সবাজার অংশে প্রতিদিনই ৪০০ শ্রমিক কাজ করছে।
রেলওয়ের প্রকল্প সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার অংশের কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালে। তখন প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু করোনার কারণে এখন আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মেয়াদ জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।
দুই ভাগে প্রকল্পের কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। একটি অংশ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আরেকটি অংশ করছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। প্রকল্পের প্রথম ভাগ দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত। দ্বিতীয় ভাগ চকরিয়া থেকে কক্সবাজার।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত রেলট্র্যাক বসে যাচ্ছে। পাশাপাশি ব্রিজ-কালভার্টের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। এখন শুধু নতুন করে ২টি আন্ডারপাস হওয়ার কারণে সেটির কাজ চলমান রয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করতে শ্রমিক বাড়িয়ে ১৮-১৯ ঘণ্টা কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব এবং কক্সবাজারে দ্রুতই ট্রেন চলাচল শুরু করবে।