একটা পলাতক দল সর্বাত্মক চেষ্টা করছে আনসেটেল করার জন্য: বিবিসি বাংলাকে অধ্যাপক ইউনূস
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 03-03-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বিবিসি বাংলা:

বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি মীর সাব্বির। আজ আমার সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যোগ দেওয়ার জন্য।

প্রধান উপদেষ্টা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

বিবিসি বাংলা:

সর্বশেষ যখন আপনার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল ঠিক এক বছর আগে, এর মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। আপনি তখন একটা গ্রেপ্তার–আতঙ্কে ছিলেন, আপনি বলছিলেন গ্রেপ্তার–আতঙ্কের কথা। সেখান থেকে আপনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন, যার ছয় মাস পার হয়ে গেছে। এই ছয় মাসকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনি যা করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, তাতে কতটা সফল হয়েছেন?

প্রধান উপদেষ্টা: প্রথমেই একটা সংশোধনী বলি, গ্রেপ্তার–আতঙ্ক—আমার কাছে কোনো আতঙ্ক ছিল না। একটা সম্ভাবনা ছিল যে আমাকে নিয়ে যাবে। আই ওয়াজ টেকিং ইট ইজি যে নিলে নেবে, আমার তো করার কিছু নেই। যেহেতু আইনকানুন নেই দেশে, কাজেই তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে। ওর মধ্য দিয়ে জীবন চলছিল আমার। সরকার যখন গঠিত হলো, আমার কোনো চিন্তা ছিল না, ভাবনা ছিল না যে আমি হঠাৎ করে একটা সরকারের প্রধান হব, দায়িত্ব পাব এবং সেই দেশ এমন দেশ, যেখানে সব তছনছ হয়ে গেছে। কোনো জিনিস আর ঠিকমতো কাজ করছে না। যা কিছু আছে, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হবে। কাজেই আমার প্রথম চেষ্টা ছিল সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আসল চেহারাটা বের করে আনা। মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে আনা। সেই চেষ্টার মধ্যে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ভবিষ্যৎটা কী হবে, সেটার জন্য চিন্তা করা—কোন দিকে আমরা অগ্রসর হব। প্রথম চিন্তা এল যে একটা সংস্কার দরকার আমাদের। কারণ, যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী সরকার চলতে পেরেছে। ১৬ বছর ধরে চলতে পেরেছে, আমরা কিছুই করতে পারিনি। তিন-তিনটা নির্বাচন হয়ে গেল, ভোটারের কোনো দেখা নেই। এই যে অসংখ্য রকমের দুর্নীতি, ব্যর্থতা, মিসরুল ইত্যাদি, সেখান থেকে আমরা কীভাবে টেনে বের করে আনব। টেনে বের করে আনতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো করতে হবে। সে জন্য প্রথমে আমরা ঠিক করলাম...

বিবিসি বাংলা:

কতটা টেনে বের করে আনতে পেরেছেন বলে মনে হয় আপনার কাছে?

প্রধান উপদেষ্টা: সংস্কারের বিষয়ে? সংস্কার তো এখনো শুরু করিনি...

বিবিসি বাংলা:

না, যে বিষয়ে আপনি বলছিলেন, যখন প্রধান উপদেষ্টা হলাম, তখন একধরনের পরিস্থিতি ছিল...

প্রধান উপদেষ্টা: অনেক পরিবর্তন...

বিবিসি বাংলা:

কতটা পরিবর্তন? আপনার চোখে কী মনে হয়?

প্রধান উপদেষ্টা: বহু পরিবর্তন। এটা আমি বলব, যে ধ্বংসাবশেষ থেকে এসেছিলাম, তার নতুন চেহারা আসছে। ভেসে উঠছে যে আমরা অর্থনীতি সহজ করেছি। দেশ-বিদেশের আস্থা অর্জন করেছি। এটা তো পরিষ্কার, সারা দুনিয়ায় আমরা আস্থা স্থাপন করতে পেরেছি। এটা কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না যে আমি অমুক দেশের আস্থা অর্জন করতে পারিনি। যে দেশেই বলুন, তারা আমাদের ওপর আস্থা স্থাপন করেছে। শুধু আস্থা স্থাপন করেছে না, বিপুলভাবে করেছে। তারা বলছে, আমরা অতীতে যা করিনি তার চেয়ে বেশি করব এখন, যেহেতু আমরা দেখছি, সুন্দরভাবে সরকার চলছে এখন। সে জন্য তারা বলছে। কাজেই এটা একটা তো বড় প্রমাণ। যখনই আপনি দেশের সারিগুলো দেখবেন, প্রতিটি দেশ নিজে এসে বলেছে, আমরা তোমাদের সমর্থন করছি। তোমাদের যা দরকার আমরা দেব। অবিশ্বাস্য রকমের সহায়তা দিয়েছে তারা।

 

বিবিসি বাংলা:

বিদেশে আপনি আস্থা ও সমর্থনের কথা বলছেন, আমি যদি দেশের প্রসঙ্গে আসি, আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে আসি; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কিন্তু অনেক সমালোচনা হচ্ছে। আমি যদি পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান দেখি, অপরাধ কিন্তু বেশ কিছুটা বেড়েছে। তো এটা আপনারা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?

প্রধান উপদেষ্টা: আস্থার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আস্থার কথাতেই ফিরে যাই, দেশ-বিদেশের আস্থা। দেশের মানুষের আস্থা আছে কি না আমদের ওপর, এটাই তো বড় কথা। আমার মনে হয়, দেশের মানুষের আস্থা আমাদের ওপর আছে। বিপুল পরিমাণে আছে। কাজেই সেটা হলো বড় প্রমাণ। আমরা কী করছি না করছি—এগুলো খুচরো বিষয় আছে। আমাদের খুচরো বিষয় এটাতে ভালো, ওটাতে মন্দ—কিছু ভালো, কিছু মন্দ হতে থাকবে। এটা একটা অপরিচিত জগৎ, আমরা এসেছি। আমরা কোনো এক্সপার্ট এখানে এসে বসিনি। আমরা এসেছি যার যার জগৎ থেকে, নিজের মতো করে চেষ্টা করছি কীভাবে করতে পারি। তার মধ্যে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। কিছু ভালো করেছে, কিছু ভালো করতে পারেনি। এটা হতে পারে। এটা আমি তো অস্বীকার করছি না।

বিবিসি বাংলা:

ভালো হয়নি কোনটা আপনার চোখে?

প্রধান উপদেষ্টা: কোনোটাই ভালো হয়নি সে অর্থে। যত ইচ্ছা আমদের—আমাদের ইচ্ছা তো অনেক। রাতারাতি দেশ পরিবর্তন করতে চাই। সেটা তো আমরা পারিনি। সময় লাগবে। আমরা চেয়েছিলাম, এখনই সংলাপটা শুরু করব। এটাও পারিনি। সংলাপ শুরু হতে হতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। এগুলো আরকি। যেগুলো সময়মতো করতে চেয়েছি, ওই সময়ে করতে পারিনি। আমরা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছি। আমাদের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। তারা দিতে পারেনি। আমি অভিযোগ করছি না। কারণ, বিশাল একটা কাজ। আরেকটু সময় চেয়েছে—এক মাস, দুই মাস। ওইটুকু একটু পিছিয়ে গেছে। এগুলো আরকি; কাজ করতে গেলে যা হয়।

বিবিসি বাংলা:

সংস্কারের কথা বলছিলেন, আমরা যদি আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ফিরে আসি, পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, অনেকেই বলছেন যে তাঁরা নানা রকম ভয়ে আছেন, আতঙ্কে আছেন, যেহেতু অপরাধটা তাঁরা দেখছেন, রাস্তাঘাটে যেটা হচ্ছে। এটা আপনারা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?

প্রধান উপদেষ্টা: অবনতিটা কোন পয়েন্ট থেকে হয়েছে? এটা বলতে হবে তো আমাকে। আপনি বলছেন অবনতি হয়েছে। কোন রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে অবনতিটা হয়েছে? সেটা না দিলে তো আমরা বুঝতে পারব না।

বিবিসি বাংলা:

আমি যদি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের কথা বলি, গত বছর এই সময় থেকে অপরাধের পরিমাণ রাস্তাঘাটে যেমন...

প্রধান উপদেষ্টা: আমি তো হিসাব নিচ্ছি। অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। আগের মতোই হয়েছে।

 

বিবিসি বাংলা:

আমি যদি একটা পরিসংখ্যান আপনাকে দিই, গত ছয় মাসে...

প্রধান উপদেষ্টা: একটা দিয়ে তো আর বিচার হবে না; সমস্ত কিছু নিয়ে আসতে হবে।

বিবিসি বাংলা:

ছয় মাসে ডাকাতির সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এটা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী। সেটা আমি বলছি। হয়তো পরিসংখ্যান বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এটা আছে এবং হচ্ছে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?

প্রধান উপদেষ্টা: চেষ্টা করছি আমরা। সমস্যা আপনিও জানেন, আমিও জানি। প্রথম দিকে সমস্যা ছিল যে পুলিশ বাহিনী, যাদের দিয়ে আমরা কাজ করাচ্ছিলাম, তারা ভয়ে রাস্তায় নামছিল না। দুই দিন আগে তারা এদের গুলি করেছে। কাজেই মানুষ দেখলেই সে ভয় পায়। কাজেই তাকে ঠিক করতে করতেই আমাদের কয়েক মাস চলে গেছে। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। এখন আবার নিয়মশৃঙ্খলার দিকে আমরা রওনা হয়েছি। কাজ করতে থাকব।

বিবিসি বাংলা:

সেই অপরাধের পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, যেটাকে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বলা হচ্ছে। যেমন গণপিটুনির একটা বিষয় দেখা গেছে। কিছুদিন আগের কথা যদি বলি, ধানমন্ডি ৩২–সহ সারা দেশে অনেক ভবনে ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এগুলো চললেও সরকারের কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। তখন কেন তেমন ভূমিকা দেখা গেল না? আপনি পরে এটা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন কেন কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি?

প্রধান উপদেষ্টা: সময় নিচ্ছে। তারা প্রস্তুত হয়ে নিয়ে তাদের মানসিকতা থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি। এটা একটা জিনিস হতে পারে। আরেকটা হলো যে আমরা তাদের বলেছি, যেকোনো পুলিশ স্টেশনে তারা যেকোনো রিপোর্ট করতে পারে। আইনের আশ্রয় নিতে পারে এবং সেটাকে আমরা সহজ করেছি এখন। বলছি, তোমরা ইন্টারনেটে দিয়ে দিতে পারো, অনলাইন পেজ করতে পারো। যাতে মামলা করতে গিয়ে, হয়রানি হয়—বরাবরই বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য, থানায় গেলে যে সমস্ত হয়রানি হয়, সেটা থেকে বাঁচার জন্য যেন অনলাইন করে। সেই অনলাইনের ব্যবস্থা করছে। যা যা আমাদের মনে হয়েছে, মানুষকে সহজ করা যাবে, তাদের তথ্য আদান–প্রদান সহজ করা যাবে, মামলা করা সহজ করা যাবে ইত্যাদি।

বিবিসি বাংলা:

অনলাইনে তাঁরা করতে পারছেন, সেটা আপনারা সহজ করেছেন, কিন্তু আসল কাজটা তো পুলিশকে করতে হবে। আপনি যে বলছেন পুলিশ সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি, তারা নিজেরা আস্থা পাচ্ছে না বা তারা সেভাবে সক্রিয় হচ্ছে না। প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে, এখনো তাদের আস্থার সংকটটা দূর করা গেল না?

প্রধান উপদেষ্টা: এখনো সম্ভব হয়নি। বাট চেষ্টা করছি। অনেক ইম্প্রুভ হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।

 

বিবিসি বাংলা:

আপনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গে আসি। আপনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তার আগে যে আলোচনা হয়েছে, সেখানে তিনটি পক্ষকে সক্রিয় দেখা গিয়েছিল। একটি হচ্ছে সেই গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা, রাজনৈতিক দলগুলো এবং তৃতীয়টি হচ্ছে সেনাবাহিনী। এই তিন পক্ষের সবাই আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তখন আপনাদের অন্তর্বর্তী সরকারের যে সম্পর্ক ছিল, এখনো কি সেটা আছে? নাকি এখন সেই অবস্থা আর নেই?

প্রধান উপদেষ্টা: আমার তো অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। কেউ আমাকে অসমর্থন করছে, এ রকম কোনো খবর তো আমি পাইনি এখনো। সবাই সমর্থন করছে, সবাই চাইছে যে সুন্দরভাবে দেশ চলুক, তাদের সবার মধ্যে ঐক্য আছে।
রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে অনেক তফাত আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরেছে। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।

বিবিসি বাংলা:

আমি যদি একজনের কথা বলি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি বক্তব্যে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা: জনমনে...ওনার মনে সন্দেহ হয়েছে কি না, এটা হলো কথা।

বিবিসি বাংলা:

তাদের মনে কেন সন্দেহ তৈরি হবে?

প্রধান উপদেষ্টা: সে করেনি তো। সে কথাই বলছি। আমরা যখন বসি, কেউ তো বলেনি যে সন্দেহ হচ্ছে। সে বলছে, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।

বিবিসি বাংলা:

মানে আপনাদের সামনে ভিন্ন কথা বলছে, কিন্তু বক্তব্যে ভিন্ন কথা বলছে। তা–ই কি হচ্ছে?

প্রধান উপদেষ্টা: ভিন্ন বলছে কি না, সেটা আপনারা বোঝেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো ঘাটতি হয়নি।

 

বিবিসি বাংলা:

ছাত্রদের প্রসঙ্গে...ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। বা এরই মধ্যে করে ফেলেছে। সে বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে সরকার তাদের সহায়তা করছে। সরকার কি সহায়তা করছে তাদের বা করেছে?

প্রধান উপদেষ্টা: না, সরকার কোনো সহায়তা করে না। যে রাজনীতি করতে চায়, সে নিজেই ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে। তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি ছিল সরকারের ভেতরে। যিনি রাজনীতি করতে মনস্থির করেছেন, তিনি ইস্তফা দিয়ে সরকার থেকে চলে গেছেন। উনি প্রাইভেট সিটিজেনশিপে রাজনীতি করবেন, কার বাধা দেওয়ার কী আছে?

বিবিসি বাংলা:

কিন্তু আপনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় বলেছেন যে ছাত্ররাই আপনার বা আপনাদের নিয়োগকর্তা। সে কারণেই কি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি একটা সমর্থন আছে সরকারের?

প্রধান উপদেষ্টা: দেখিনি তো এখনো। দেখলে না ঠিক করব যে ওদের কাজকর্ম ভালো হচ্ছে কি না। প্রত্যকের তো মনোভাব থাকবে যে ওই রাজনৈতিক দলটা সুন্দর কাজ করছে, ওই রাজনৈতিক দলটা ঠিক কাজ করছে না। এটা মনোভাব হতে পারে ব্যক্তিগতভাবে। সরকার হিসেবে আমাদের কোনো পজিশন নেই।

বিবিসি বাংলা:

তাহলে আপনি কি বলবেন যে অভিযোগটা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেটা সঠিক নয়?

প্রধান উপদেষ্টা: সঠিক নয় মোটেই। সেনাবাহিনী কি সহযোগিতা করছে?

বিবিসি বাংলা:

সেনাবাহিনী থেকে কি আপনি সহযোগিতা পাচ্ছেন?

প্রধান উপদেষ্টা: সর্বাত্মকভাবে।

 

বিবিসি বাংলা:

প্রথম থেকে যা ছিল, এখনো তা–ই?

প্রধান উপদেষ্টা: অ্যাবসুলেটলি।

বিবিসি বাংলা:

আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে সম্প্রতি সেনাপ্রধান একটি বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, অনেক বিষয়ে তিনি এবং আপনি একমত। তার মধ্যে তাঁর একটি বক্তব্য ছিল যে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে বা বিপন্ন হতে পারে। আপনি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত?

প্রধান উপদেষ্টা: এটা ওনার বক্তব্য, উনি বলবেন। আমার ওনাকে এনডোর্স করা না–করার তো বিষয় নয়।

বিবিসি বাংলা:

যেহেতু উনি বলেছেন, অনেক বিষয়ে কথা হয়। আপনি অনেক বিষয়ে একমত। অথবা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না? সরকারপ্রধান হিসেবে আপনি কী মনে করেন?

প্রধান উপদেষ্টা: এটা তো সব সময় থাকে। একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে আনসেটেল করার জন্য। এটা তো সত্য, সব সময় থ্রেট আছেই। প্রতিক্ষণেই আছে, প্রতি জায়গাতেই আছে। কাজেই এটা তো সব সময় থাকবে।

বিবিসি বাংলা:

হুমকিটা কি আপনি বলছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ থেকে?

প্রধান উপদেষ্টা: অবশ্যই। এটা তো অবভিয়াস। তারা মাঝেমধ্যেই ঘোষণা করছে। বক্তৃতা দিচ্ছে। অ্যাড্রেস করছে। আপনি-আমরা সবাই শুনছি। মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে।

 

বিবিসি বাংলা:

আওয়ামী লীগের বিষয়ে আপনারা বলেছেন বা আপনি এখন যেটা বললেন, তাদের দিক থেকে নানা কর্মকাণ্ড আছে। হুমকিটা কোথায়?

প্রধান উপদেষ্টা: এই যে অ্যাড্রেস করছে। জাগো, কাজে নামো ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক আহ্বান জানাচ্ছে না—কর্মসূচি দিচ্ছে, হরতাল করো, অমুক করো। মানুষ কীভাবে নেবে এটাকে বলেন? এটা কি মিষ্টি যে মুখে চলে যাবে সব?

বিবিসি বাংলা:

অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বড় লক্ষ্য হিসেবে আপনি সংস্কারের কথা বলেছেন। এটি নিয়ে আপনি অনেকগুলো কমিশনও গঠন করেছেন। কিন্তু এখন যেহেতু আপনারাই বলছেন যে বছরের শেষে নির্বাচন হবে। তো এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা সংস্কার কতটা করতে পারবেন বলে মনে করেন?

প্রধান উপদেষ্টা: সেটা আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা একেবারে প্রতিটা সুপারিশ দেব। সুপারিশের সঙ্গে কথা থাকবে যে আপনার রাজনৈতিক দল এটা কি সমর্থন করে? এটাতে রাজি আছেন? রাজি থাকলে বলেন, রাজি না থাকলে বলেন। বা এই যে সুপারিশটা আছে, সেটার মধ্যে যদি কোনো একটা সংশোধনী এনে রাজি হবেন, সেটা বলেন। এটা কি নির্বাচনের আগে সংশোধন করা ঠিক হবে, নাকি নির্বাচনের পরে—সব প্রশ্নের এখানেই সমাবেশ আছে। রাজনৈতিক দলকে শুধু বলতে হবে কোনটা? সবকিছু মিলালে আমরা এটা ঠিক করব কোন সুপারিশে সবাই একমত হয়েছে। সেটা আলাদা করব যে এটায় সবাই একমত হয়েছে। এ রকম যে সমস্ত সুপারিশে তারা একমত হয়েছে, সেগুলো আমরা আলাদা একটা কাগজে নিয়ে আসব যে এসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে এটাকে আমরা বলব একটা চার্টার—জুলাই চার্টার। সবাইকে আহ্বান জানাব, আপনারা সবাই যেহেতু একমত হয়েছেন, এটাতে সই করে দেন। জুলাই চার্টারের মতোই আমরা চলব। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনটা হবে। নির্বাচনের আগে যেটা বলেছেন সেটা নির্বাচনের আগে হবে, যেটা নির্বাচনের পরে বলেছেন সেটা নির্বাচনের পরে হবে। এটা আপনাদের বিষয়। কিন্তু আপনারা একমত হয়েছেন। সেই ঐকমত্যই আমরা গঠন করার চেষ্টা করছি।

বিবিসি বাংলা:

তবে কি বলা যায় যে নির্বাচনটা এ বছরের মধ্যেই হচ্ছে?

প্রধান উপদেষ্টা: আমরা তো সেটা ঘোষণা করে দিয়েছি। আবার নতুন করে বলার তো কিছু নেই।

বিবিসি বাংলা:

সর্বশেষ যখন আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন আপনি একটা বিষয় বলেছিলেন যে আপনার ওপরে যে মামলা, হয়রানি—এসব কারণে আপনি ব্যক্তিগত জীবনে নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। এখন সরকারের সাত মাস হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে থাকার পর আপনার ব্যক্তিগত জীবন কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে?

প্রধান উপদেষ্টা: আমি তো এখন ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। এখন তো আমার জীবন অন্য রকমের। বদ্ধ ঘরে কাজ করার মতো জীবন। আমার এদিকে–ওদিকে কাজ করার সুযোগ নেই। যেটুকু করার, খুবই সীমাবদ্ধভাবে আমাকে ফোকাসড ওয়েতে সেগুলো কাজ চলছে। কাজেই ওটার সঙ্গে এটার কোনো তুলনা করতে পারছি না আমি। ওটা আমি ফ্রি জীবন। যা ইচ্ছা, তা–ই করছিলাম। এখন তো আর সেটা করা যাচ্ছে না।

 

বিবিসি বাংলা:

গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি দেখা গেছে। দুই দেশের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে?

প্রধান উপদেষ্টা: খুবই ভালো। আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি। আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছি, আমাদের সম্পর্ক সব সময় ভালো থাকবে। এখনো ভালো আছে, ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, আমাদের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি এবং ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এত ক্লোজ সম্পর্ক, সেটা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে পারব না। তবে মাঝখানে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, আমি বলেছি মেঘ দেখা দিয়েছে। এই মেঘগুলো মোটামুটি এসেছে অপপ্রচার থেকে। অপপ্রচারের সূত্র কারা, সেটা অন্যরা বিচার করবে। কিন্তু এই অপপ্রচারের ফলে আমাদের সঙ্গে একটা ভুল–বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। সেই ভুল–বোঝাবুঝি থেকে আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।

বিবিসি বাংলা:

ভারত সরকারের সঙ্গে আপনার সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে?

প্রধান উপদেষ্টা: সব সময় যোগাযোগ হচ্ছে। তারা এখানে আসছে, আমাদের লোকজন সেখানে যাচ্ছে। প্রাইম মিনিস্টার মোদির সঙ্গে আমার প্রথম সপ্তাহেই কথাবার্তা হয়ে গেছে।

বিবিসি বাংলা:

ইলন মাস্কের সঙ্গে সম্প্রতি আপনার কথা হয়েছে এবং তাঁকে আপনি বাংলাদেশে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা?

প্রধান উপদেষ্টা: এটা মূলত ছিল স্টারলিংক নিয়ে। এটা ব্যবসায়িক একটা সম্পর্কের বিষয় ছিল। সে বিষয়ে আমরা আলাপ করছি যে স্টারলিংকের কানেকশনটা আমরা নিতে চাই।

বিবিসি বাংলা:

আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা গেছে, বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলছেন। এটা নিয়ে আপনার অবস্থানটা কী?

প্রধান উপদেষ্টা: ওই যে ঐকমত্য, আমরা বরাবরই ফিরে যাচ্ছি ঐকমত্যে। সবাই মিলে যা ঠিক করবে, আমরা তা–ই করব।

 

বিবিসি বাংলা:

এ বিষয়ে আপনার সরাসরি অবস্থান নেই বা আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ হবে বা রাজনীতি করবে কি না, নির্বাচনে অংশ নেবে কি না?

প্রধান উপদেষ্টা: আমি অত ডিটেইলসে যাচ্ছি না। আমার বরাবরই পজিশন হলো যে আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক। আমাদের এ দেশের ওপরে সমান অধিকার। আমরা সব ভাই ভাই। আমাদের এ দেশেই বাঁচতে হবে। এ দেশকেই বড় করতে হবে। কাজেই যে মত-দল করবে, তার মতো করে সবকিছু করবে। এ দেশ থেকে কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে অন্যায় করেছে, যার বিচার হওয়া উচিত, তার বিচার হতে হবে; এটুকুই শুধু।

বিবিসি বাংলা:

বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, তাতে সরকারপ্রধানের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির একটা নিয়মিত যোগাযোগ থাকার কথা। বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ হয়?

প্রধান উপদেষ্টা: যখনই প্রয়োজন হয়। শুধু শুধু তো গিয়ে ওনার সময় নষ্ট করার দরকার নেই। যখনই দরকার হয়, আমি তো তাঁর কাছে যাই।

বিবিসি বাংলা:

এর আগে সাক্ষাৎকারে আপনি একটা কথা বলেছিলেন যে এক-এগারোর সময় আপনি যে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল এবং আপনি বলেছিলেন যে আপনার রাজনীতিতে আসাটা ভুল হয়েছে। এখন আপনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পদে রয়েছেন। এখন আপনার কী মূল্যায়ন? এখানে আসা কি আপনার সঠিক হয়েছে, নাকি এখনই বিচার করতে চান না?

প্রধান উপদেষ্টা: না, বিচার করব। প্রথম কথা, আমি রাজনৈতিক দল গঠন করিনি। গঠন করার কথা বলেছিলাম। ১০ সপ্তাহ যাবৎ এই কথা জারি ছিল। ১০ সপ্তাহ পর আমি বলেছি, না, আমি রাজনীতিতে যাব না। আমি বলেছি যে পলিটিকস ইজ নট মাই কাপ অব টি। ওটা ওখানেই সমাপ্ত, এরপর আমাকে রাজনীতির কাছে কেউ টানতে পারেনি। সবাই চেষ্টা করেছে দেশের নেতৃত্ব নেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী হন। সবাই চেষ্টা করেছে। আমি ওটা চাইনি। আমি বলেছি, ওই চ্যাপটার শেষ। এই ১০ সপ্তাহ— দ্যাটস এনাফ। কাজেই ওইভাবেই আছি এখন। এখানে আমি রাজনীতিতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজনীতি করিও না।

বিবিসি বাংলা:

কিন্তু এটা একটা রাজনৈতিক পদ, সরকারপ্রধান...

প্রধান উপদেষ্টা: এটা টেকনিক্যালি হলে হবে। আমি তো এই পদে আসতেও চাইনি। আমাকে অনুরোধ করেছে, বহুবারই করেছে। তারপর আমি শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়েছি। সেটার দায়িত্ব নিয়েছি। রাজনৈতিক পদ যদি হয়ে থাকে, এটা বাই ডেফিনেশন। আমি রাজনীতি করি না।

 

বিবিসি বাংলা:

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য।

প্রধান উপদেষ্টা: ধন্যবাদ আপনাকেও।

শেয়ার করুন