অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ‘রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের সেন্ট জেমস প্যালেসে যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লস এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তি, রাষ্ট্রদূত ও সমর্থকদের উপস্থিতিতে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
কিংস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ফাউন্ডেশনের চেয়ার অব ট্রাস্টিজ ডেম অ্যান লিম্ব অধ্যাপক ইউনূসের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। বিভিন্ন বিভাগে আরও কয়েকজন ‘কিংস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫’-এ ভূষিত হয়েছেন।
কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ‘রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশেষ এই পুরস্কার এমন এক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, যিনি ‘দ্য কিংস হারমনি’ দর্শনের প্রতি দীর্ঘ মেয়াদে অসামান্য নিষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং এটিকে সমর্থন দিয়েছেন। এ দর্শন সব ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থা ও প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়।
অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে ওয়েবসাইটে বলা হয়, তিনি সামাজিক ব্যবসার নীতি প্রচারে এবং টেকসই, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পগুলো উৎসাহিত করতে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি বাংলাদেশ ও এর বাইরেও দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
২০২৪ সালের জুন মাসে রাজা চার্লস প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের উদ্যাপন হিসেবে নতুন এ পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এ পুরস্কারের প্রথম বিজয়ী ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন।
১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য কিংস ফাউন্ডেশন’। এ দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলসের উদ্যোগে গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অসামান্য অবদানের জন্য এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার দিয়ে থাকে।
আরও যাঁরা ‘কিংস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫’ পেলেন
‘ইমার্জিং ট্যালেন্ট’ (উদীয়মান প্রতিভা) পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এমিলি হার্স্ট। এ পুরস্কার সম্পর্কে বলা হয়, এটি এমন একজনকে দেওয়া হয়, যিনি কিংস ফাউন্ডেশন প্রোগ্রামে থাকাকালীন ব্যতিক্রমী প্রতিভা ও অঙ্গীকার দেখিয়েছেন। এমিলির হাতে পুরস্কার তুলে দেন ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহাম।
এমিলি হার্স্ট সম্প্রতি হাইগ্রোভ গার্ডেন্স (বিখ্যাত বাগান ও এস্টেট, যা রাজা তৃতীয় চার্লসের ব্যক্তিগত বাসভবনের অংশ) থেকে পরিচালিত ‘শ্যানেল অ্যান্ড কিংস ফাউন্ডেশন মেটিয়ার্স ডি’আর্ট ফেলোশিপ ইন মিলিনারি’ সম্পন্ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এমিলি নিজ থেকে ঐতিহ্যবাহী খড় বুননের কারুশিল্প শিখেছিলেন, যা তাঁকে ইতিহাসভিত্তিক নির্ভুল হ্যাট (একধরনের টুপি) তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এ দক্ষতা তাঁর বর্তমান কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসের হাতে পুরস্কার তুলে দেন কিংস ফাউন্ডেশনের চেয়ার অব ট্রাস্টিজ ডেম অ্যান লিম্বছবি: কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে
‘ইন্টারন্যাশনাল ইমপ্যাক্ট’ (আন্তর্জাতিক প্রভাব) ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে ‘আকোজে রেসিডেন্সি’। এ পুরস্কার সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি এমন এক ব্যক্তি বা সংস্থাকে দেওয়া হয়, যে বা যারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে আসছে।
আকোজে রেসিডেন্সি সম্পর্কে বলা হয়, আকোজে রেসিডেন্সি মারো ইতোজে ও খালিল আকার প্রতিষ্ঠিত একটি অলাভজনক উদ্যোগ। স্কটল্যান্ডের ডামফ্রিস হাউসভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো, আন্তসংস্কৃতি বিনিময় ও অবকাঠামোগত সহায়তার মাধ্যমে আফ্রিকা, ক্যারিবীয় এবং এসডব্লিউএএনএ বা সোয়ানা (দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা) অঞ্চলের শিল্পীদের সহায়তা করা।
‘ইয়াং এন্ট্রাপ্রেনার’ (তরুণ উদ্যোক্তা) পুরস্কার পেয়েছেন বার্নাবি হর্ন। এ পুরস্কার কিংস ফাউন্ডেশনের একজন সাবেক শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়, যিনি সফলভাবে নিজের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন এবং তা সম্প্রসারিত করেছেন।
বার্নাবি হর্ন লন্ডনভিত্তিক একজন হ্যাট প্রস্তুতকারক। তিনি সম্প্রতি হাইগ্রোভ গার্ডেন্স থেকে পরিচালিত ‘শ্যানেল অ্যান্ড কিংস ফাউন্ডেশন মেটিয়ার্স ডি’আর্ট ফেলোশিপ ইন মিলিনারি’ সম্পন্ন করেছেন।
‘টিচিং অ্যাওয়ার্ড’ (শিক্ষকতা পুরস্কার) পেয়েছেন ক্লদিয়া পেনিয়ারান্দা ফুয়েন্তেস। কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এ পুরস্কার এমন একজনকে দেওয়া হয়, যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম জ্ঞান বা দক্ষতা কিংবা দুটিই ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
ক্লদিয়া পেনিয়ারান্দা বহু বছর ধরে কিংস ফাউন্ডেশনের টেকসই উন্নয়নবিষয়ক মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রামে শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে তিনি উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যও। বর্তমানে সরকারি পরিবহন সংস্থা ট্রান্সপোর্ট ফর লন্ডনে রোড ডিকার্বোনাইজেশন স্ট্র্যাটেজি লিড হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।
‘ইনোভেশন ইন প্র্যাকটিস’ (কর্মক্ষেত্রে উদ্ভাবন) পুরস্কার পেয়েছেন ইয়াসমিন লারি। এ পুরস্কার এমন এক ব্যক্তি বা সংস্থাকে দেওয়া হয়, যে বা যাঁরা প্রকৃতি থেকে উৎসারিত সমাধান বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
ইয়াসমিন লারি পাকিস্তানের প্রথম নারী স্থপতি। তিনি স্থাপত্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও জলবায়ুসচেতন নির্মাণপদ্ধতির মধ্যে সংযোগ স্থাপনে একজন অগ্রণী কণ্ঠস্বর।
‘অ্যাডভোকেট অব দ্য ইয়ার’ (বর্ষসেরা প্রবক্তা) পুরস্কার দেওয়া হয়েছে প্যাট্রিক হোল্ডেনকে। এটি এমন এক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, যিনি সারা বছর ‘হারমনি’ দর্শন প্রচারে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। উল্লেখ্য, হারমনি দর্শন হলো, রাজা তৃতীয় চার্লসের একটি জীবনদর্শন। এ দর্শনের মূল বক্তব্য হলো মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে জীবনযাপন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
প্যাট্রিক হোল্ডেন ‘সাসটেইনেবল ফুড ট্রাস্ট’–এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তাঁর প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, আরও টেকসই খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থার দিকে রূপান্তরকে জোরদার করতে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করা।
এমিলি হার্স্টের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহামছবি: কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে
‘বর্ষসেরা কমিউনিটি পার্টনারশিপ’ পুরস্কার পেয়েছে অচিনলেক প্রাইমারি স্কুল। কিংস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে বছরজুড়ে অসাধারণ অবদান রাখা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
অচিনলেক প্রাইমারি স্কুল ৪-১২ বছর বয়সী ১৮০ জন শিক্ষার্থীর একটি বিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এলাকা থেকে আসে। এই স্কুল কিংস ফাউন্ডেশনের ‘হারমনি’ শিক্ষা কার্যক্রম সানন্দে গ্রহণ করেছে এবং তাদের কর্মীদের বার্ষিক পাঠপরিকল্পনায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা দিয়েছে এবং উৎসাহিত করেছে।
বর্ষসেরা করপোরেট পুরস্কার পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান প্যাটাগোনিয়া। নিজেদের কার্যক্রমে ‘হারমনি’ দর্শন বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে একনিষ্ঠতা দেখিয়ে যাওয়া কোনো সংস্থাকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্যাটাগোনিয়া হলো ভ্রমণের আনুষঙ্গিক পোশাক, সরঞ্জাম ও খাবারের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৫ সালে প্যাটাগোনিয়া তাদের লাভের ১০ শতাংশ পরিবেশ সংরক্ষণে যুক্ত গোষ্ঠীগুলোকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে প্রতিষ্ঠানটি এ প্রতিশ্রুতি বাড়িয়ে বিক্রয়ের ১ শতাংশ পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থাগুলোকে দেওয়া শুরু করে।
প্যাটাগোনিয়া জলবায়ু-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর জন্য বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার অনুদান দেয়। তারা দেখাতে চায়, পরিবেশ রক্ষা করলে ব্যবসাও সফল হতে পারে।