দিনাজপুরের এলিজাবেথ মারান্ডী (৪৫) একজন সাঁওতাল নারী। বাংলাদেশ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে। কখনো পড়াশোনার ফাঁকে চাকরি, কখনো চাকরির ফাঁকে পড়াশোনা। কাজ করেছেন দেশি–বিদেশি উন্নয়ন সংস্থায় মাঠপর্যায়ে।
এলিজাবেথ মারান্ডী ২০১৫ সালে বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জননীতি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। দেড় বছর পর দেশে ফেরেন। এরপর একটি খ্যাতনামা বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) হয়ে নওগাঁ ও রাজশাহীতে দুটি প্রকল্পে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন।
চাকরি থেকে নারীর বিরতি নেওয়াকে ভালো চোখে দেখা হয় না। কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ধরে নেওয়া হয়, কোথাও চাকরি পাচ্ছে না।
এলিজাবেথ মারান্ডী, ব্র্যাকের ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ কার্যক্রমে নির্বাচিত নারী
২০২২ সালে প্রকল্প শেষে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় স্বামীর সঙ্গে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করে বিক্রির কাজে যোগ দেন এলিজাবেথ মারান্ডী। তবে আর্থিক বিষয় বিবেচনা করে তিনি ফিরতে চান চাকরিতে।
কিন্তু এ দেশের প্রেক্ষাপটে কোনো নারীর কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়ার পর ফেরা তত সহজ হয় না। সেটি বুঝতে পারছিলেন এলিজাবেথ। এ সময় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ (কাজে ফিরিয়ে আনার সেতুবন্ধ) কার্যক্রমের কথা জানতে পারেন। তাতে আবেদন করে নির্বাচিতও হয়ে যান। ব্র্যাকের ক্ষুদ্র অর্থায়ন বিভাগে কাজের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
ব্র্যাক জানিয়েছে, ব্রিজ রিটার্নশিপ ব্র্যাকের এমন একটি নতুন উদ্যোগ, যেটির মাধ্যমে কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়া নারীদের কাজে ফেরার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কোনো কারণে কর্মজীবন থেকে বিরতি নিয়েছেন, কিন্তু আবার কাজে ফিরতে চান—এমন নারীদের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে ব্রিজ রিটার্নশিপ।
‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ ব্র্যাকের এমন একটি নতুন উদ্যোগ, যেটির মাধ্যমে কর্মজীবন থেকে বিরতি নেওয়া নারীদের কাজে ফেরার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কোনো কারণে কর্মজীবন থেকে বিরতি নিয়েছেন, কিন্তু আবার কাজে ফিরতে চান, এমন নারীদের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’।
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে এ কার্যক্রমের জন্য আবেদনপত্র নেওয়া হয়। এক হাজারের বেশি আবেদনপত্র থেকে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এলিজাবেথের মতো ১৫ জন নারীকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাঁরা সংযুক্ত হয়েছেন ব্র্যাকের বিভিন্ন বিভাগে।
যে ওই নারীর কর্মদক্ষতা নেই। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ‘ব্রিজ রিটার্নশিপ’ কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে।
মৌটুসী কবীর, ব্র্যাকের ‘জনগণ, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ’ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক
এলিজাবেথ প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিতে ফেরা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ভুগছিলেন। মনে হচ্ছিল, যে কাজ করছিলেন, তা দিয়ে চাকরিতে ফেরা যাবে কি না। ব্র্যাকের ব্রিজ রির্টানশিপ কার্যক্রম তাঁর জন্য বড় সুযোগ তৈরি করে দিল। তিনি আরও বলেন, চাকরি থেকে নারীর বিরতি নেওয়াকে ভালো চোখে দেখা হয় না। কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ধরে নেওয়া হয়, কোথাও চাকরি পাচ্ছেন না।
নিশাত বিলকিসছবি: সংগৃহীত
ওই ১৫ নারীর একজন নিশাত বিলকিস (৩৮)। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি জানান, ২০২০ সালের মে মাসে তিনি মা হন। ওই সময় কোভিড–১৯ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ভীতি ছিল। তাই সন্তানের সঙ্গে থাকার প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি ছয় বছরের চাকরিটা ছেড়ে দেন। এরপর ২০২২ সালে আবার চাকরিতে যোগ দেন। সেটাও এক বছরের বেশি করতে পারেননি। স্বামীর পদায়ন কেনিয়াতে হওয়ায় সন্তানসহ সেখানে চলে যান। গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন।
নিশাত বলেন, ‘আমি নিজের সিদ্ধান্তেই চাকরি থেকে বিরতি নিই। জানুয়ারি মাসে ব্র্যাকের ব্রিজ রিটার্নশিপ কার্যক্রম দেখে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, আবার কাজে ফিরতে চাইছিলাম। নির্বাচিত হওয়ায় খুব ভালো লাগছে।’
মেরী শর্মিলা কর্মকার
একই রকমের কথা বললেন ওই কার্যক্রমে নির্বাচিত আরেক নারী মেরী শর্মিলা কর্মকার (৪০)। মা–বাবা আর তিন বোন মিলে তাঁর সংসার। বোনদের মধ্যে তিনি বড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন থেকে পাস করা মেরী প্রথম চাকরিতে যোগ দেন ২০১১ সালে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন। সর্বশেষ একটি প্রতিষ্ঠানের যে প্রকল্পে ছিলেন, সেটি শেষ হয়ে যায় গত বছরের মার্চে। ওই সময় মায়ের অসুস্থতা বেড়ে গেলে তিনি আর চাকরির খোঁজ করেননি।
মেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট দুই বোনও চাকরি করে। মাকে ওই সময় প্রায়ই হাসপাতালে নিতে হতো। তাই আমিই চাকরি থেকে বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এখন মায়ের অবস্থা স্থিতিশীল। কাজে ফিরে আসার জন্য ব্র্যাকের কার্যক্রমে আবেদন করে নির্বাচিত হই।’ তিনি বলেন, কর্মজীবনে বিরতি হওয়া মানেই চাকরি থেকে ছিটকে পড়া নয়—এই বোধ তৈরি হওয়া প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত নারীর জন্য এভাবে ফেরার সুযোগ রাখা। তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারী–পুরুষের অসমতা কমে আসবে।
ব্র্যাকের ‘জনগণ, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ’ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক মৌটুসী কবীর বলেন, মাতৃত্ব, পরিবারের ঠিকানা বদল হওয়া, মা–বাবার অসুস্থতা, নারীর নিজেরই বিরতি নেওয়ার ইচ্ছা ইত্যাদি কারণে কোনো কোনো নারীর চাকরিজীবনে বিরতি পড়ে। পেশায় বিরতি পড়ার মানে এই নয় যে ওই নারীর কর্মদক্ষতা নেই। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ব্রিজ রিটার্নশিপ কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে।
মৌটুসী কবীর জানান, ব্র্যাকের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে কাজের সুযোগ পাওয়া ও প্রশিক্ষণ নেওয়া নারীদের ডেটাবেজ থাকবে ব্র্যাকে। আশা করা যায়, কাজের যোগ্যতার ভিত্তিতে তাঁরা ব্র্যাক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। ব্র্যাকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানেও কাজের সুযোগ পেতে পারেন। ব্র্যাক নিজেও অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন রাখবে এই নারীদের কাজের সুযোগ দেওয়ার। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও নারীদের কর্মজীবনে ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।