বিশ্বজুড়ে বর্ষবরণ: সবাইকে ছাপিয়ে যে কারণে অনন্য বাঙালির সর্বজনীন উদযাপন
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 14-04-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত


নববর্ষ। এই শব্দটি নিজেই যেন আহ্বান জানায় নতুন সূচনার। ঐ যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—। ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি নতুন তারিখ, আর জীবনের পাতায় নতুন সম্ভাবনার গল্প দিয়েই তো শুরু হয় একটি নতুন বছর। আমাদের জীবনে রোমান বছরের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ বিশ্বজুড়ে এই বছরকেই অনুসরণ করা হয়। আমরাও উপনিবেশিকতার রেশ ধরে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তবুও বাংলা বছরও আমাদের কাছে সমান গুরুত্ব পায়।

নববর্ষের সর্বজনীন ও আনন্দঘন উদযাপন

নববর্ষের সর্বজনীন ও আনন্দঘন উদযাপন

নববর্ষ মানেই আনন্দ

নববর্ষ মানেই আনন্দউইকিমিডিয়া কমন্স

রোমান বছর যেটা আমাদের কাছে ইংরেজি বছর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সেটা আনুষ্ঠানিকতার বছর হিসেবে ধরা হলে, বাংলা বছর বস্তুত আমাদের প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য এই বছরের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। দেশ, কাল নির্বিশেষে নতুন বছরের সঙ্গে কিছু বিষয় যেমন রং, পোশাক, খাবারদাবার কিংবা ঐতিহ্য  ইত্যাদি কেমন করে যেন একাত্ম হয়ে আছে। এগুলোকে উদযাপন, আনুষ্ঠানিকতা এমনকি রীতি পালনের উপাদান বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। আর এসবেই নিজেদের মতো করে একেক দেশের মানুষ নববর্ষকে সাজায়, বরণ করে নেয় নিজেদের রঙে, ঐতিহ্যে, অশনে, বসনে।

বিজ্ঞাপন

 

রঙে ভুবন ভরা

রং দিয়েই না হয় শুরু করা যাক। বিশ্বজুড়ে নতুন বছরের আবাহনে রং একটি গুরুত্বপূর্ণ। আর এক্ষেত্রে যেন লালেরই রাজত্ব। সব দেশেরই বলতে গেলে নববর্ষে আয়োজন, উদযাপন জুড়ে আছে লাল। নজরুলের ভাষায়' লালে লাল দুনিয়া'। কিন্তু এই লাল কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বজনীন নববর্ষের রং খুঁজতে গেলে জিতে যাবে লাল। কারণ লাল মানেই শক্তি, প্রাণ, সাহস আর সৌভাগ্য। এটা এমন এক রং যা চোখে পড়ে, মনে থাকে, আর নেতিবাচকতাকে দূরে ঠেলে আশার বার্তা শোনায়।

চীনা নববর্ষে লাল-সোনালি ঐতিহ্যবাহী পোশাক

চীনা নববর্ষে লাল-সোনালি ঐতিহ্যবাহী পোশাকউইকিমিডিয়া কমন্স

লালের ছড়াছড়ি দেখা যায় চাইনিজ নিউ ইয়ারে

লালের ছড়াছড়ি দেখা যায় চাইনিজ নিউ ইয়ারেউইকিমিডিয়া কমন্স

বিশেষ করে চীনে, নববর্ষের সময় চারপাশে লাল রঙের ছড়াছড়ি—লাল খাম (হংবাও), লাল লণ্ঠন, লাল পোশাক, এমনকি আতশবাজির রঙেও লালের আধিপত্য। কারণ তারা বিশ্বাস করে, এই রঙ অশুভ আত্মাকে দূরে রাখে আর নিয়ে আসে সমৃদ্ধি। আরও আছে। এই রং উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেয়; ভালোবাসা আর উষ্ণতা ছড়ায়।কিন্তু আমাদের লাল কোথা থেকে এলো এটাও একটা প্রশ্ন বটে। যেমন প্রশ্ন উঠতে পারে সান্টা বুড়োর রং নিয়েও।

 

 

একটা ধারণা থেকে বলা হয়ে থাকে, বাংলা নতুন বছর মোগলরা চালু করে খাজনা দেওয়ার সুবিধার জন্য। তখন লাল সালুতে বেঁধে টাকা নিয়ে যাওয়া হতো। সেই থেকেই নাকি লাল এসেছে।

আমাদের লাল-সাদায় অনুপ্রাণিত হন বিদেশিরাও

আমাদের লাল-সাদায় অনুপ্রাণিত হন বিদেশিরাও

তবে যেভাবেই আসুক না কেন আমাদের লাল জ্বলে ওঠে প্রাণের উচ্ছ্বাসে।আবার সান্টার রং কিন্তু তিনরকম ছিল। তিনি মূলত লম্বা আলখাল্লা ধরনের পোশাক পরতেন। এর রং কখনও ছিল সোনালি, কখনও গাঢ় লাল বা বেগুনি। কিন্তু আধুনিক সান্তাকে আমরা জানি মানে লাল–সাদা মোটা দাড়িওয়ালা হাসিখুশি মানুষ; এটা মূলত দানশীলতার জন্য সুবিদিত পাদ্রি সেইন্ট নিকোলাসের চেহারা নয়। তবে সান্টাকে আগে লাল–সাদায় মাঝে মধ্যে দেখা গেলেও তার এই নাদুসনুদুস রূপ জনপ্রিয় হয়েছে বস্তুত কোকাকোলার কল্যাণে।

সান্টার কল্যাণে এখন ক্রিসমাস মানেই সান্টা হ্যাট আর লাল-সাদা

সান্টার কল্যাণে এখন ক্রিসমাস মানেই সান্টা হ্যাট আর লাল-সাদা

১৯৩১ সালে, কোকাকোলার একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। আর কৃতিত্ব শিল্পী হ্যাডন সান্ডব্লমের। তিনি কোকের একটি ক্রিসমাস ক্যাম্পেইনের জন্য সান্টার যে চেহারা আঁকেন, তাতে তিনি লাল–সাদা রঙে সান্টাকে উপস্থাপন করেন কোকাকোলার ব্র্যান্ড রঙের সঙ্গে মিল রেখে। আবার সাদা তো বিশুদ্ধতা, শান্তি, পবিত্রতার প্রতীক। অন্যদিকে তুষারের রঙ সাদা, যেটা শীতকালীন ক্রিসমাসের আবহকে ফুটিয়ে তোলে। যিশুর জন্ম নতুন সূচনার প্রতীকও সাদা। জাপানে সাদা হল পবিত্রতা ও মানে জীবন সূচনার রং।

কোরিয়ান নিউ ইয়ারে ঐতিহ্যবাহী পোশাক

কোরিয়ান নিউ ইয়ারে ঐতিহ্যবাহী পোশাকউইকিমিডিয়া কমন্স

আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় নীল, সাদা ও হালকা গোলাপি শান্তি আর ঐতিহ্যের প্রতীক। ভারতে, হলুদ ও কমলা আনন্দ ও পবিত্রতার বার্তাবাহক। আমাদের দেশে সাদা সাদা হয়ে ওঠে বিশুদ্ধতার প্রতীক। সোনালীও কিন্তু দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশেষ আবেদনময়। বিশেষত চীনে। কারণ এই রং ধনী, সুখী, শুভ ও শান্তিময় সময়ের রঙ।

 

নববর্ষের পোশাক-কথা

কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় পোশাককে? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। সব দেশেই কমবেশি নতুন পোশাক পরে থাকে। তবে রাজকীয়তা লক্ষ করা যায় চীন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার নববর্ষের পোশাকে। চীনে নতুন পোশাক (বিশেষ করে লাল) পরা মানে ভাগ্যকে আহ্বান জানানো। ভিয়েতনামের আও জায় পরা বলা যেতে পারে নববর্ষের অপরিহার্য রীতি। আবার কোরিয়ায় ঐতিহ্যবাহী হানবক পরে পরিবারের সবাই নববর্ষ উদযাপন করে। কিন্তু আমাদের দেশে লাল–সাদা গরদের শাড়ি পরে পূজা দিতে দেখা যায়। এই চল বহু বছর ধরে চলে আসছে। তবে আপামর জনসাধারণ মনে হয় না আর কোনো দেশে আমাদের মতো করে নতুন পোশাক পরে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। যদিও এই ধারার সূচনা খুব বেশি দিনের নয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের ফ্যাশন হাউসগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রতি বছর প্রচুর কেনাবেচা হয় বৈশাখের শাড়ি

প্রতি বছর প্রচুর কেনাবেচা হয় বৈশাখের শাড়ি

বর্তমানে ঈদের পর বৈশাখ সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। কেবল পোশাক নয়, নানা অনুষঙ্গ, তৈযসপত্রও এই বাজারকে আবও বিস্তৃত করেছে। এখানে একুট বলে রাখা ভালো আমাদের এই ভূখন্ডে নারীর পোশাক ছিল শাড়ি আর পুরুষের ধুতি। এখন তো আমরা অতি উৎসাহী হয়ে ধুতিকে হিন্দুদের পোশাক বলে দাগিয়ে দিয়েছি। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।

এদিনের নতুন পোশাকে প্রাধান্য থাকে লাল ও সাদার

এদিনের নতুন পোশাকে প্রাধান্য থাকে লাল ও সাদার

তাই অন্তত বছরের প্রথম দিনে নারীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে থাকে। পুরুষ পরে না। ধুতি পরা ঝক্কির বলে পাঞ্জাবিদের পোশাককে আপন করে নিয়েছে। কি আর করা। তবে লাল আর সাদায় মাতোয়ারা হয়েছে থাকে চারপাশ। ডিজাইনরাও এই উপলক্ষ্যে নিজেদের সৃজনশীলতা দেখান। যেটা বলতে গেলে বিশ্বে বিরল।

 

বর্ষবরণে রিচুয়ালের প্রভাব

আমাদের দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আজকের সকালে পূজা দেওয়ার প্রচলন আছে। যদিও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় রীতির প্রচলন নেই। অন্যদিকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া নববর্ষে রিচুয়ালকে অনন্য গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

অনেক দেশেই নানা রিচুয়াল থাকে বছরের প্রথম দিনে

অনেক দেশেই নানা রিচুয়াল থাকে বছরের প্রথম দিনে

অবশ্য বহু বছর ধরে বর্ষবরণের শুরুটা হয় রমনা বটমূলে

অবশ্য বহু বছর ধরে বর্ষবরণের শুরুটা হয় রমনা বটমূলে

জাপানিরা বছরের প্রথম দিনে মন্দিরে যায়। এটাকে তারা হাতসুমোদে বলে থাকে। এই আচার মূলত নতুন বছরকে আবাহনের প্রার্থনা। কোরিয়রা খাবার সাজিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে।

 

অশন বিনে উৎসব মিছে

বাঙালির উৎসব ভোজন ছাড়া জমে না। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। রসনার বিলাসে মেতে ওঠে অন্যরাও। তাদের কথা না হয় আগে বলে নেওয়া যাক। নববর্ষ মানে আহার সম্ভারের উপস্থাপনাও বটে। এটা চীনারা বেশ করে থাকে। কম যায় না ফিলিপিনো ও ইতালিয়রা।

চাইনিজ নিউ ইয়ারের ডাম্পলিং

চাইনিজ নিউ ইয়ারের ডাম্পলিং

চীনে বছরের প্রথম দিনে ডাম্পলিং খাওয়াটাই রেওয়াজ। কারণ এটাকে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। ফিলিপাইনে এদিন গোল গোল করে কেটে ফল ও মিষ্টি পরিবেশন করে। কারণ তাদের কাছে এটা সমৃদ্ধির প্রতীক। ইতালিয়ানরা ইতালিতে লেন্টিলস ও সসেজ পরিবেশনের মাধ্যমে সমৃদ্ধির আহ্বান জানায়!

আর বাঙালি? সে আর বলতে চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়তেই বর্ষকে বরণ করে। পান্তাভাত এখন নববর্ষে সবার প্রিয় খাবার। ইলিশ থাকবে কিনা সে আলোচনা আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আর পান্তার পাশাপাশি ভর্তা-ভাত, মাছ, খিচুড়ির মতো অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবার তো আছেই। সঙ্গে 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে'-র আহ্বানও কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। তাই বিশ্ব এসে হাজির হয়ে যায় বাঙালির পাতে।

 

রঙের ভেতর দিয়ে বিশ্ব দেখা

নববর্ষ কেবল তো একটা তারিখ নয়, নয় একটা দিন। এটা মূলত অনুভব। এর সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। যেখানে মাত্রা যোগ করে রং। কেউ রিচুয়ালে খুঁজে পায় মানে, কেউ পোশাকে, কেউ আবার খাবারে। তবে সব কিছুর মাঝে রঙ—বিশেষ করে লাল—একটি নিঃশব্দ সেতু হয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাসকে যুক্ত করে দেয় গোটা পৃথিবীর উদযাপনের সঙ্গে। এখানেই অন্যদের থেকে বাঙালি আলাদা। সবার কাছে যেখানে উদযাপনের অংশ হিসেবে রিচুয়াল গুরুত্ব পায়, বাঙালি সেখানে উদযাপনকে নিখাদ করে আবেগের ভেলায় ভেসে; উৎসবের আনন্দে আদ্যন্ত মজে গিয়ে। কারণ বাঙালি আর কিছু নয় এই নতুনের আবাহনে মালিন্যকে দুর করতে চায়, মুখর হতে চায় জীবনের জয়গানে।  

রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উদযাপন চলতে থাকে এদিন

রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উদযাপন চলতে থাকে এদি

সব বয়সের মানুষই যোগ দেয় উৎসবে

সব বয়সের মানুষই যোগ দেয় উৎসবে

নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এই উপলক্ষে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নতুনভাবে আবিষ্কার করাও হয়ে ওঠে বিশেষ কিছু। এখানেও বাঙালির প্রয়াস কুর্নিশের দাবি রাখে। শুভ নববর্ষ! নতুন রঙে রাঙুক জীবন।

 

 

শেয়ার করুন