মেক্সিকো ও কানাডার আমদানি করা পণ্যে শুল্ক আরোপ ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পর ট্রাম্প এ কথা জানান।
সীমান্ত সুবিধা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে ‘বিজয়’ হিসেবে দেখাতে পারেন ট্রাম্প। অন্যদিকে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেনবাউম ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও এটাকে নিজেদের ‘রাজনৈতিক বিজয়’ বলতে পারেন।
যা–ই হোক, ট্রাম্পের পক্ষ থেকে উত্তর আমেরিকা ও বাকি বিশ্বকে অর্থনৈতিকভাবে সাময়িক কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো বাণিজ্যযুদ্ধ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কার লাভ, কার ক্ষতি হয়েছে? এরপর কী ঘটতে পারে? এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বিবিসির সংবাদকর্মী কোর্টনি সুব্রামানিয়াম বলেন, ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সহযোগীদের সঙ্গে চরম দ্বন্দ্বে ট্রাম্পের কূটনৈতিক উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মেক্সিকো ও কানাডা—দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে রাজি হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশ দুটি অবৈধ অভিবাসী ও ফেন্টানিলের মতো ক্ষতিকর মাদক পাচার ঠেকাতে আরও বড় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও রাজি হয়েছে।
অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য দেশকে চাপে ফেলার মধ্য দিয়ে স্বার্থ হাসিলের কৌশলটি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির জন্য একটি বিজয়। এটা ট্রাম্পকে মার্কিন ভোক্তাদের মহাদেশীয় বাণিজ্যযুদ্ধের অর্থনৈতিক পরিণতি অনুভব না করিয়ে অভ্যন্তরীণ মূল বিষয়গুলো পূরণের দারুণ সুযোগ এনে দেয়।
যদিও ট্রাম্পের শুল্কনীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপের ঘটনায় মেক্সিকো, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। যদিও অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, এসব পদক্ষেপের পরিধি অনেকটা সীমিত ছিল।
এবার ট্রাম্প মেক্সিকো, কানাডা ও চীনা পণ্যে ব্যাপক শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্থানীয় সময় আজ মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে চীনা পণ্যের ওপর বর্তমান হারের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা রয়েছে। কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যে আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক আপাতত ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
কিন্তু ৩০ দিনের সময়সীমা পেরোনোর পর ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে এই শুল্কনীতিবিষয়ক হুমকি আবারও কার্যকর করবেন কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। এমন অনিশ্চয়তা আশঙ্কা জাগায়, এসব ব্যবসায় মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরতা কমতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন কারখানা নির্মাণে বিনিয়োগ ও কর্মী নিয়োগ বন্ধ করা হতে পারে। অন্তত যতক্ষণ বাণিজ্য অনিশ্চয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে না উঠছে, ততক্ষণ পর্যন্ত।
৩০ দিনের জন্য শুল্ক আরোপ স্থগিতের ঘটনা কানাডার রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ী নেতাদের স্বস্তি এনে দিয়েছে। শুল্ক আরোপের হুমকি রয়ে গেলেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এটাকে রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দাবি করতে পারেন।
এই ইস্যুতে ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে কানাডার রাজনীতিবিদেরা রীতিমতো হিমশিম খেয়েছেন। কেননা, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল নয়। মেয়াদের শেষ সপ্তাহগুলোতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভূমিকাও তেমন জোরালো নয়।
কানাডার পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদিও এসব নতুন কোনো ব্যবস্থা নয়।
গত ডিসেম্বরে কানাডা ১৩০ কোটি কানাডীয় ডলার অর্থায়নের ঘোষণা দেয়। ফেন্টানিলের মতো মাদক পাচার ব্যাহত করা, আইন প্রয়োগের জন্য নতুন সরঞ্জাম এবং মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে এই অর্থ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
দুই দেশের সীমান্তে এরই মধ্যে কানাডার নজরদারি ড্রোন এবং দুটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার টহল দিতে শুরু করেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চালানো এসব উদ্যোগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, কানাডা ট্রাম্পের সীমান্ত উদ্বেগকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, নিচ্ছে।
এই বাণিজ্য সংকটের সময় মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেনবাউম ‘মাথা ঠান্ডা রাখতে’ ও ‘শান্ত থাকতে’ আহ্বান জানিয়েছেন।
এমনকি গত শুক্রবারও ক্লাউদিয়া শেনবাউম বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প সরে আসবেন। ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর শেনবাউমের কথাই সত্য হয়েছে।
চুক্তি ঘোষণার পরপর শেনবাউমের মুখে হাসি দেখা গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি ‘মাস্টারক্লাস’ হিসেবে এটাকে দেখছেন তাঁর সমর্থকেরা।
ফেন্টানিল পাচার ঠেকানোর বিষয়ে মনোযোগ দিতে সীমান্তে ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের মোতায়েনের বিষয়ে রাজি হয়েছেন শেনবাউম। তবে ট্রাম্পের কাছ থেকে যা চান, সেটাও কৌশলগতভাবে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
শুল্ক আরোপ সাময়িক স্থগিতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রের পাচারের বিরুদ্ধে ট্রাম্প আরও কিছু করবেন, তেমন প্রতিশ্রুতি আদায়ে সমর্থ হয়েছেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট।
এর পাশাপাশি মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সময় পেয়েছেন।
এখন ধারণা করা হচ্ছে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শিগগিরই মেক্সিকো সফর করবেন। সেই সঙ্গে ফেন্টানিলের পাচার বিষয়ে মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি যৌথ দল গঠন করা হবে।
প্রকৃতপক্ষে ক্লাউদিয়া শেনবাউম দুই দেশের মধ্যে আরও বিস্তৃত বাণিজ্য বৈরিতা আপাতত রুখে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এটি তাঁর নতুন সরকারের প্রথম ‘উল্লেখযোগ্য বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গত অক্টোবরে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
এ পরিস্থিতি ট্রাম্পের সঙ্গে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের মধ্যে ভবিষ্যতে আলাপচারিতার পরিবেশ তৈরি করবে।