নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এত দিন ধরে ইরানের অর্থনীতি কীভাবে টিকে আছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 21-06-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে বিশ্ববাসীর কৌতূহল, ইরান ঠিক কীভাবে এ রকম জবাব দিচ্ছে? ইরানের ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য বেশি হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম ভেদ করে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে, তাতে ইরানের সক্ষমতা মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, অর্থনৈতিকভাবেই–বা তারা কীভাবে এই যুদ্ধের সংস্থান করছে?

বিষয়টি হলো, ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর থেকেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূলে পরিণত হয়। বিশেষত তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে ইরানের বিপ্লবীদের হামলার পর পরিস্থিতির ঘোরতর অবনতি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে দেশটির ওপর।

মাঝে বারাক ওবামা এসব নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করলেও ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম জমানায় আবারও নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়। ফলে পশ্চিমা জনমনে ধারণা ছিল, ইরান হয়তো বেশি সময় পাল্টা আক্রমণের ধার বজায় রাখতে পারবে না। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে এখন পর্যন্ত ইরান পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে। খবর আল-জাজিরা ও বিবিসির।

 

ইরানের অর্থনীতির ভিত যতটা না নীতিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নির্ভরশীল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর। বিশ্বে সবচেয়ে বড় গ্যাস ও তেলের মজুদদারদের মধ্যে অন্যতম দেশটি হচ্ছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালেও গ্যাস মজুতের দিক দিয়ে ইরান ছিল দ্বিতীয় আর তেলে তৃতীয় বৃহত্তম।

এই বিপুল সম্পদের একাংশের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে। এই দেশটি ঘেঁষেই রয়েছে হরমুজ প্রণালি—বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এই জলপথ দিয়েই প্রতিদিন বিশ্বে ব্যবহৃত তেলের ২১ শতাংশ সরবরাহ হয়।

তেল ও গ্যাস খাতে ইরানের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও কিছু সময় ইরান থেকে তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য কিনেছে। এক দশক নিষেধাজ্ঞার পর ২০২০ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এমন কিছু ক্রয় তথ্য আমেরিকান কর্তৃপক্ষই প্রকাশ করেছে।

শুধু জ্বালানি নয়, কৃষিপণ্যেও শক্তিশালী ইরান। ইরান শুধু জ্বালানি বা খনিজ রপ্তানি করেই নয়, খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের বাজারেও আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয়। দেশটি গম, যব, আপেল, কমলা, আখ, আলু, সবজি, মুরগির মাংসসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উল্লেখযোগ্য রপ্তানিকারক।

 

এর পাশাপাশি সিমেন্ট, সার, রাসায়নিক পদার্থ, নির্মাণসামগ্রী, লৌহ-ধাতব পণ্য, টেক্সটাইল ও অস্ত্র রপ্তানিতেও আছে ইরানের সক্রিয় উপস্থিতি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এসব খাতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে—বলছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার। বাংলাদেশের বাজারেও ইরানি আতর, রত্নপাথর কিংবা বিখ্যাত জাফরান নিয়মিতভাবে পাওয়া যায়।

পারস্য সাম্রাজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাদের পণ্যের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও ওয়াশিংটনের অনেক কার্পেটের দোকানে ইরানের কার্পেট বিক্রি হয়। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এসব পণ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে দূর দেশের বাজারে পৌঁছে যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ ছাড়া বিকল্প পথে বাঁচার চেষ্টাও করছে ইরান। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিনিময় প্রথা, হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অঘোষিত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুরস্ক, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ তাদের আঞ্চলিক বাণিজ্যবন্ধু। এই পদ্ধতিগুলো আইনিভাবে স্বীকৃত না হলেও নিষেধাজ্ঞার চাপে থাকা ইরানের জন্য এগুলো বিকল্প আর্থিক রসদ হিসেবে কার্যকর হয়ে উঠেছে।

ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানও তাদের শক্তির অন্যতম উৎস। দেশটি এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে তারা চাইলেই পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সদর সিটিতে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ

ইরানে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সদর সিটিতে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভছবি: রয়টার্স

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান নিজস্ব উৎপাদন ও প্রযুক্তিতে নির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করেছে এবং অনেকাংশে তারা সফলও হয়েছে। অভ্যন্তরীণ শিল্প, প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে তারা কিছুটা স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্ব নিয়ে জনগণের নানা প্রতিক্রিয়া থাকলেও অনেকেই স্বীকার করেন, এই কঠোর শাসনকাঠামোই ইরানকে টিকিয়ে রাখার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা প্রভাব মোকাবিলা ও আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখার প্রশ্নে। বিষয়টি হলো, ইরান এখন আর কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, তারা প্রক্সি নেটওয়ার্কের নেতৃত্বদানকারী কেন্দ্র। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের মিলিশিয়া গোষ্ঠী, ইয়েমেনের হুতি, সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বাহিনীসহ পুরো অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ব্যাপক।

সামরিক শক্তি

ইরানের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। যদিও দেশটির সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন বা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার শুরুটা হয়েছিল রেজা খান বা রেজা শাহ পাহলভির হাত ধরে ১৯২০–এর দশকে। তিনি সেনা কমান্ডার থেকে পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী ও রাজা হয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হওয়ার পর তিনি আরতেশ বাহিনী গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর সূচনা হয়। তিনি ইরানকে আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি হাজার হাজার অফিসারকে বিদেশে সামরিক একাডেমিতে পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি নিজ দেশের বাহিনীর সম্প্রসারণ করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পশ্চিমা অফিসারও নিয়োগ দেন (সূত্র: দ্য মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট)।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের দখল নেয়। নাৎসি জার্মানির সঙ্গে সুসম্পর্কের জেরে রেজা শাহকে সরিয়ে রাজার আসনে আনা হয় পশ্চিমাপন্থী হিসেবে পরিচিত তাঁর পুত্র মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে। সেই অভিযোগে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবে রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশছাড়া করা হয়।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্যানুসারে, সামরিক সক্ষমতায় ১৪৫টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪তম, ইসরায়েলের (১৭তম) চেয়ে তারা এগিয়ে। তাদের হিসাবে, ইরানের ৫৫১টি সামরিক বিমান, ১২৯টি হেলিকপ্টার, ৬৫ হাজার ৭৬৫টি সাঁজোয়া যান, ১ হাজার ৯৯৬টি ট্যাংক, ১০১টি যুদ্ধজাহাজ ও ১৯টি ডুবোজাহাজ রয়েছে। তবে ইরানের অস্ত্র নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সেখানেও পাওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, সেখানে ইরানের নৌবাহিনীতে আকাশযান বা হেলিকপ্টার বহন করার সক্ষমতা নেই বলা হয়, যদিও ২০২১ সালে ইরানের সামরিক মহড়ার প্রকাশিত ছবিতে মাকরান নামের একটি হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ দেখা যায়।

 

কীভাবে এই সক্ষমতা

প্রশ্ন হলো, কঠোর নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে থেকেও কীভাবে এতটা সামরিক সক্ষমতা অর্জন করল ইরান? বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভরতা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ।

‘নিজস্ব অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করতে ইরান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে তারা বহু সময় চোরাচালানের মাধ্যমে অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করেছে’ বলে বিবিসির কাছে মন্তব্য করেন ইরানবিষয়ক বিশ্লেষক হুশ্যাং হাসান ইয়ারি। তাঁর মতে, রাশিয়ার সহযোগিতার পাশাপাশি চীন ও উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশের ওপর ইরান কিছুটা নির্ভরশীল। ফলে নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলে তারা প্রতিরক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন করতে পেরেছে।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই ইরান অস্ত্র খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার বলছে, ইরানের বার্ষিক সামরিক বাজেট আনুমানিক ৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ৯৯৫ কোটি ডলার। তবে ইয়ারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যেহেতু পশ্চিমাদের তুলনায় ইরানের অস্ত্র প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে কম নিখুঁত, তাই তারা প্রতিক্রিয়ামূলক ও কৌশলগত যুদ্ধে ব্যবহারের প্রয়োজনে বেশি পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে।

ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা উচ্চ পর্যায়ের বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিবিসিকে তাঁরা বলেন, ইরানে এমন অনেক গবেষক আছেন, যাঁরা ন্যানোটেকনোলজি থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও চিকিৎসা প্রযুক্তি—বিভিন্ন খাতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদেশি প্রযুক্তি সহজে আমদানি করা না গেলেও দেশীয় উদ্ভাবনে জোর দিয়ে ইরান এখন নিজস্ব প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানিও করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সরাসরি অস্ত্র ও প্রযুক্তির রপ্তানি ছাড়াও ইরান তার প্রভাবশালী প্রক্সি গোষ্ঠী ও সামরিক সহায়তার মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। নিষেধাজ্ঞার চাপ উপেক্ষা করে তারা ‘স্বনির্ভরতা’ ও ‘প্রতিরোধ’ কৌশলের পথে হাঁটছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের হাইফা শহরে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতা। ইসরায়েল, ২০ জুন ২০২৫

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের হাইফা শহরে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতা। ইসরায়েল, ২০ জুন ২০২৫ছবি: এএফপি

চ্যালেঞ্জ

তবে বছরের পর বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা থাকা কাজের কথা নয়। আল–জাজিরার সংবাদে বলা হয়েছে, ইরান এখন কেবল রাজনৈতিকভাবে নয়, জীবনযাত্রার নানা সংকটে বিপর্যস্ত। বিদ্যুৎ ও পানির তীব্র ঘাটতি, মুদ্রার বিনিময় হারে ধস, আঞ্চলিক মিত্রদের ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে সংকট বহুমাত্রিক রূপ নিচ্ছে। প্রতিটি সংকট পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে আরও গভীর হয়েছে।

দেশটিতে বহু বছর ধরে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, কমছে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন। সেচব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ফলে ইরানে এখন ঘন ঘন লোডশেডিং এবং পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

২০১৮ সালে পুনরায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ডলারের বিপরীতে ৯০ শতাংশের বেশি মূল্য হারিয়েছে ইরানি মুদ্রা রিয়াল। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার বিশ্লেষকেরা এমনই তথ্য জানাচ্ছেন। ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

সরকারি হিসাবে ইরানের মূল্যস্ফীতি এখন ৪০ শতাংশের আশপাশে। তবে বাস্তবে তা আরও বেশি। ইরানি অর্থনীতি বিশ্লেষক হামজে আল গাওদ আল–জাজিরাকে আরও বলেছেন, বাস্তব মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, রিয়ালের ক্রমাগত অবমূল্যায়ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি সরাসরি সাধারণ মানুষের পকেটে চাপ তৈরি করছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম দেশটির শ্রম ও সামাজিক কল্যাণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ইব্রাহিম সাদেগিফারকে উদ্ধৃত করে জানায়, ২২ থেকে ২৭ শতাংশ ইরানি নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন।

সরকারি তথ্যানুযায়ী ইরানে বেকারত্বের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকদের সর্বোচ্চ পরিষদের মতে, যাঁরা ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না, তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি।

ইরান কতটা ব্যয় করতে পারবে

হামজে আল গাওদের মতে, তেহরানের সামরিক বাজেট তুলনামূলকভাবে কম। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, ইরান তার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ থেকে ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় ব্যয় করে—আনুমানিক ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।

তেহরানের হাতে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলেও গাওদ মনে করেন, এটাই ইরানের দুর্বলতা। তাঁর ভাষায়, ‘স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের খরচ মেটাতে যদি এ রিজার্ভ ব্যবহার করা হয়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে ইরান বড় সংকটে পড়বে।’

গাওদ আরও বলেন, সাম্প্রতিক কিছু হামলার পর জাতিগত একতা দেখা গেছে; কিন্তু হামলা আরও বাড়লে বা সাধারণ নাগরিকদের সরিয়ে নিতে হলে সেই ঐক্য সহজেই ভেঙে পড়তে পারে।

ইরানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল

ইরানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের কী অবস্থা

ইসরায়েলের অর্থনীতির আকার ইরানের চেয়ে বড় হলেও ধারাবাহিক যুদ্ধ ও সংঘাত দেশটির প্রবৃদ্ধির গতি থামিয়ে দিয়েছে। গাজায় চলমান সামরিক অভিযান আর ইরানের সঙ্গে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘর্ষ—এই দুইয়ে মিলে ইসরায়েল এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক কালপর্ব অতিক্রম করছে।

শুধু গাজা যুদ্ধেই ইসরায়েলের প্রায় ২৫০ বিলিয়ন শেকেল বা ৬৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের মাত্র প্রথম দুই দিনেই খরচ হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন বা ১৪৫ কোটি ডলার। এই গতিতে যুদ্ধ চললে মাত্র সাত সপ্তাহেই গাজা যুদ্ধের ব্যয় ছাড়িয়ে যেতে পারে।

গাজা যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশটির উৎপাদন ও বাণিজ্য খাত। ব্যবসা–সমীক্ষা সংস্থা কোফাকবিডিআই জানিয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোম্পানি। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, শ্রমিকসংকট দেখা দিচ্ছে, সরবরাহের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা এখনো গাজা আগ্রাসনের আগের অবস্থানে ফিরতে পারেনি।

সংকট আরও তীব্র হলে ইরানের দীর্ঘদিনের এই টিকে থাকার কৌশল কতটা কার্যকর হয়, তা হয়তো নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সমঝোতার ওপর। আপাতত তেল-গ্যাস ও আত্মনির্ভরতার জোরে ইরান মাঠে আছে।

শেয়ার করুন