শ্রীলঙ্কার নির্বাচনকে কেন আইএমএফ কর্মসূচির প্রতি গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 19-09-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কার মানুষ আগামী শনিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন। দুই বছর আগে নজিরবিহীন এক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির জনগণ নতুন নেতা বাছাই করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচনকে নেতা বাছাইয়ের সুযোগের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মসূচির ওপর গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। বার্তা সংস্থা এএফপি জানাচ্ছে, ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করা এবং খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের সংকট থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনার কৃতিত্ব দাবি করছেন। তিনি আরও একবার দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন।

২০২২ সালে রাজাপক্ষের বাসভবন দখল করে নিয়েছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনতা। তার ঠিক আগেই তিনি পালিয়ে যান। এরপর দায়িত্ব নিয়ে রনিল বিক্রমাসিংহে রাস্তায় শান্তি ফিরিয়ে আনেন। নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিকে তিনি বলেন, ‘সেই দিনের কথা চিন্তা করুন, যখন আমরা সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের ছিল না খাদ্য, গ্যাস, ওষুধ কিংবা কোনো আশা।’

রনিল বিক্রমাসিংহে আরও বলেন, ‘এখন আপনাদের বাছাই করার সুযোগ আছে। আপনারা কি আগের সেই ভয়ংকর দিনে ফিরতে চান, নাকি অগ্রগতি চান। আপনারাই তা ঠিক করুন।’

বিক্রমাসিংহে যা–ই বলুন না কেন, নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে আইএমএফের কর্মসূচির ওপর কার্যত একটি গণভোট। আইএমএফের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে তিনি কর বাড়িয়েছেন, নিয়েছেন নানা রকম কৃচ্ছ্র কর্মসূচি। ফলে লাখ লাখ মানুষকে জীবন চালাতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

 

Ads by

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ২০২২ সালে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার পর সরকার এখনো তা শুরু করতে পারেনি। দেশটির বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৬ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি কৃচ্ছ্রতার কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখবেন। তিনি এই বলে সতর্ক করেছেন যে আইএমএফের নির্দেশিত পথ থেকে সরে গেলে দেশটির জন্য আরও বেশি সমস্যা তৈরি হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ চলতি সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিক্রমাসিংহের সরকার অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে মোকাবিলা করেছে এবং মাঝারি মানের যে উন্নতি দেখা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে মূলত তার ওপর একটি গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে যে দেশটির সরকার বাজেট কাটছাঁট করার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ ‘কঠিন পরিস্থিতির’ মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। সরকার এমন কিছু কৃচ্ছ্র কর্মসূচি নিয়েছে, সাধারণ মানুষ যাকে অন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করে।

উদীয়মান লাল তারা

নির্বাচনে রনিল বিক্রমাসিংহের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন। তাঁদের একজন আনুরা কুমারা দিসানায়েকে। একসময় প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাওয়া মার্ক্সবাদী দলের নেতা তিনি। হিংসাত্মক অতীতের জন্য এই দলের ভাবমূর্তির সংকট ছিল। ১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকে দুটি ব্যর্থ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল দিসানায়েকের দল। ওই দুই আন্দোলনে ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলটি ৪ শতাংশের কম ভোট পায়।

তবে শ্রীলঙ্কার সংকট আনুরা কুমারা দিসানায়েকের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাঁর প্রতি বিপুল জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ‘দুর্নীতিবাজ’ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান তিনি ঘটাবেন। এই প্রতিশ্রুতির প্রতিই মানুষ সমর্থন জানিয়েছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্রোধ, তার কারণে তিনি নির্বাচনে সুবিধা পাবেন। এর পাশাপাশি রয়েছে অর্থনীতি ঠিকঠাকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা, যা দেশটির সংকটকে কেবল বাড়িয়ে তুলেছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অ্যাডভোকেটার মুরতাজা জাফারজি এএফপিকে বলেন, ‘একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার শক্তিশালী একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, আর সেটি হলো দেশ যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা অত্যন্ত অখুশি।’

নির্বাচনে আরেকজন প্রার্থী আছেন সামনের সারিতে। সাজিথ প্রেমাদাসা। তিনি সাবেক এক প্রেসিডেন্টের পুত্র, যিনি ১৯৯৩ সালে গৃহযুদ্ধের সময় আততায়ীর হাতে নিহত হন। সাজিথ প্রেমাদাসাকে রাজপুত্র হিসেবে উপহাস করে একসময় রাজনীতিতে খুবই কম গুরুত্ব দেওয়া হতো। তবে এই নির্বাচনে তিনি বেশ ভালো করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

সাজিথ প্রেমাদাসা একসময় রনিল বিক্রমাসিংহের মিত্র ও ডেপুটি ছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালে এই ৫৭ বছর বয়স্ক রাজনীতিবিদ তাঁর নেতাকে সমালোচনা করে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এই নির্বাচনে তাঁর প্রতিশ্রুতি হলো, তিনি আইএমএফের কাছ থেকে শিথিল শর্ত আদায় করবেন।

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। দিনে ৩ দশমিক ৬৫ ডলারের নিচে খরচ করে এমন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এ সময় আরও ২৫ লাখ মানুষ দিয়েছে।

আইএমএফ বলছে, দেশটিতে যে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার ফলে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। পাশাপাশি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে। অর্থাৎ সংস্থাটির মতে, তাদের দেওয়া শর্তগুলো ভালো ফলাফল দিচ্ছে।

গত সপ্তাহে আইএমএফের মুখপাত্র জুলি কোজাক ওয়াশিংটনে বলেন, অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু দেশটি এখনো বিপদমুক্ত হয়নি। যেসব অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

 

শেয়ার করুন