এক বছরের ইজারামূল্য ২৫ কোটি টাকা, এত ‘দামি’কেন মিয়ানমার সীমান্তের বাজারটি
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 08-03-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া বাজার। উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের এই বাজার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায়। গত বছর বাজারটি ইজারা হয়েছিল প্রায় আড়াই কোটি টাকায়। এবার ইজারা হয়েছে ১০ গুণ বেশি প্রায় ২৫ কোটি টাকায়।

বাজারটি ইজারা নিয়েছেন রামু উপজেলা যুবদলের সদস্যসচিব তৌহিদুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি সমর্থক ৪০ জনের বেশি নেতা-কর্মী-ব্যবসায়ী বাজারটি আগামী এক বছর নিয়ন্ত্রণ করবেন। আগে নিজের দলীয় লোকজন দিয়ে বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করতেন কক্সবাজার-৩ আসনের আওয়ামী লীগ–দলীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইউনিয়ন পর্যায়ের এই বাজার কেন এত চড়া মূল্যে ইজারা হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী এই বাজার চোরাই গরু বিক্রির হাট ও মাদক চোরাচালানের ‘ট্রানজিট’ হিসেবে পরিচিত।

 

 

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রামু উপজেলা পরিষদের উন্মুক্ত দরপত্রে গর্জনিয়া বাজারের সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে (২৫ কোটি টাকা) যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হলে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। যুবদল নেতার টাকার উৎস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রামু উপজেলার ১৩টি সরকারি হাটবাজারের প্রকাশ্যে নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের জন্য নিলাম অনুষ্ঠানে সবার নজর ছিল গর্জনিয়া বাজার। বাজারটি কার হাতে যাচ্ছে, গর্জনিয়া বাজারের জন্য ৪৫টি ফরম বিক্রি হয়। এর মধ্যে সাতজন উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নেন। যাচাই-বাছাই শেষে সর্বোচ্চ ১৯ কোটি ৯৬ হাজার টাকার দরদাতা তৌহিদুল ইসলামের নাম ঘোষণা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতার নামও ঘোষণা করা হয়। তাঁরা ১০ কোটির কম বেশি দর দিয়েছিলেন। সরকারি সূত্রমতে, ১৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ভ্যাট-করসহ বাজারের মোট ইজারা মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২৫ কোটি টাকাতে।

 

এর সত্যতা নিশ্চিত করে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের একটি বাজারের ইজারামূল্য ২৫ কোটিতে যাবে, কল্পনাতে ছিল না। সম্ভবত সারা দেশের মধ্যে গর্জনিয়া বাজার সর্বোচ্চ দামের ইজারা। ইজারামূল্যের ৩০ শতাংশ জামানত হিসেবে ইতিমধ্যে ৬ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। অন্যান্য ইজারামূল্যও নিয়মমাফিক আদায় করা হবে। সর্বোচ্চ মূল্যে বাজার ইজারা হলে সরকারের লাভ।

২৫ কোটি টাকায় দুর্গম পাহাড়ের গর্জনিয়া বাজার ইজারা প্রসঙ্গে তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে বাজারটি কমল (সাবেক সংসদ সদস্য) সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করত। তাঁরা মিয়ানমারের চোরাই গরু এনে বাজারের ইজারামূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন প্রতিযোগী বেড়েছে অনেক। তাই বাজারের ইজারা ২৫ কোটিতে ঠেকেছে।

গর্জনিয়া বাজার ইজারা নিয়েছেন যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম

গর্জনিয়া বাজার ইজারা নিয়েছেন যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামছবি: সংগৃহীত

এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি একা নন, রামু, কক্সবাজার, ঈদগাঁও এলাকার বিএনপি সমর্থক ৪০ জন ব্যবসায়ী ও হোটেল-মালিক মিলে সম্প্রতি ‘বিজনেস ফোরাম’ গঠন করেছেন। প্রতিজন ৫০ লাখ টাকা করে ২০ কোটি টাকা জমা করেছেন। সেই টাকায় গর্জনিয়া বাজার ইজারা নেওয়া হয়েছে। অনেক শেয়ারহোল্ডার থাকলেও বাজার ইজারা হয় একজনের নামে। তাঁর বাড়ি গর্জনিয়াতে, তিনি গর্জনিয়া বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সেই হিসেবে বাজারটি তাঁর নামে নেওয়া হয়েছে।

দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকার পরও টাকার উৎস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা প্রসঙ্গে যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জমিদার পরিবারের সন্তান। তা ছাড়া ৫০ লাখ টাকার প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে আরও বিনিয়োগ থাকে। সে ক্ষেত্রে গর্জনিয়া বাজারের অংশীদার অনেক।’

দরপত্র অনুযায়ী প্রতি মাসে হাটবাজার থেকে ইজারা তুলতে হবে দুই কোটি টাকার বেশি। ইজারা উশুলের বিপরীতে এত গরু গর্জনিয়া বাজারে পাওয়া যাবে কি না, জানতে চাইলে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘লাভ–লোকসান ভাগ্যের ব্যাপার। কেউ যদি বাজারে মিয়ানমারের গরু নিয়ে আসে, করার কিছু নাই। কারণ, আমরা তো চোরাই গরুর ব্যবসাতে নাই।’

বাজারটির ইজারামূল্য কেন এত বেশি

গর্জনিয়া বাজারটি রামু উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কাছে। যেতে হয় নাইক্ষ্যংছড়ির থানার পাশ দিয়ে। এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা থেকে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখা হয়। বাজারটিতে দোকান রয়েছে প্রায় ৫০০টি। এ ছাড়া বাজারের অধীনে আরও দেড় কিলোমিটার দূরে রয়েছে গরু বিক্রির আড়াই কানির একটি মাঠ।

পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন বছরে গর্জনিয়া বাজার ‘দামি’ হয়ে ওঠে। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজারো গরু গর্জনিয়া বাজারে আনা হতো। তারপর ইউনিয়ন পরিষদের কাগজমূলে চোরাই গরু স্থানীয় হিসেবে হতো বিক্রি। সবচেয়ে বেশি গরু আনা হয় ২০২৪ সালে—অন্তত ৩ লাখ। গরুর উল্লেখযোগ্য অংশ গর্জনিয়া বাজার ঘুরে কক্সবাজার, ঈদগাঁও, চকরিয়া হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হতো। গরুপ্রতি সরকারি-বেসরকারি খাতে গড়ে ২২ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হতো। গরুর বহরে লুকিয়ে আনা হতো ইয়াবা ও আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) বড় চালান। মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী কম দামে গরুর সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের চালান পাঠিয়ে বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল সংগ্রহ করত।

 

পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গরু ও ইয়াবার চালান লুটের ঘটনা নিয়ে গর্জনিয়ার শাহীন ডাকাত বাহিনীর সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে। বিজিবির সঙ্গেও কারবারিদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসরুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, খুনসহ একাধিক মামলার আসামি ও ডাকাত বাহিনীর প্রধান শাহীনকে ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। তাঁর নেতৃত্বে গরু ও মাদকের ব্যবসা চলে। সম্প্রতি ডাকাত শাহীন বাহিনীর অস্ত্র প্রশিক্ষক ভিকচান মিয়াকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় পুলিশ ১১টি গরু জব্দ করে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, টানা ১১ মাসের সংঘাতের পর গত ৭ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ (২৭০ কিলোমিটার) এলাকা দখলে নিয়েছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এলাকা থেকে বিতাড়িত লোকজনের গৃহপালিত পশু কম দামে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে সেখানকার কারবারিরা। সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের বড় চালান পাঠাচ্ছে। মূলত মাদক চোরাচালান ঘিরে কয়েক বছর ধরে গর্জনিয়া বাজার দখলের প্রতিযোগিতা চলে আসছে।

এর আগে ২০২৩ সালে (১৪৩০ বঙ্গাব্দ) ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় গর্জনিয়ার এই বাজার ইজারা পেয়েছিলেন রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুছ ভুট্টো। ইউনুছ সাবেক সংসদ সদস্য কমলের ঘনিষ্ঠজন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দুজন আত্মগোপনে চলে যান।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে (১৪৩১ বঙ্গাব্দ) গর্জনিয়া বাজারের ইজারা হয়েছিল ২ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা দরে। ইজারা পেয়েছিলেন কক্সবাজার সদরের বাসিন্দা ও কেবি ইউনিট অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক আবদুর রহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে গরু আনা হয় ঠিক। কিন্তু ওই গরু গর্জনিয়া বাজারে আনার পর দেশি বলে দাবি করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যানের কাগজ থাকে। তা ছাড়া হাটবাজারে কোনটি মিয়ানমারের, কোনটি দেশি গরু, তা পরখ করা যায় না।

৫ আগস্টের পর থেকে কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নোমানও পলাতক। ফলে চোরাই গরুকে দেশি বলে লিখিত দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।

চোরাচালানের বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি মাসরুরুল হক ও ও রামু থানার ওসি ইমন চৌধুরী বলেন, তাঁরা সব সময় নজরদারিতে রাখেন। নিয়মিত অভিযানও চলছে।

শেয়ার করুন