যুক্তরাষ্ট্রকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত থেকে রক্ষা করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে চেয়েছিলেন জো বাইডেন। কিন্তু এর বদলে ট্রাম্পকে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য হয়তো তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
৮২ বছর বয়সী বাইডেনকে আগামী বছরগুলোয় আরও সদয়ভাবেও মূল্যায়ন করা হতে পারে। ডেমোক্র্যাট দলের এ নেতা কোভিড-১৯ মহামারি ও এর আগে ট্রাম্পের প্রথম চার বছরের বিশৃঙ্খলা থেকে বিভক্ত দেশকে বের করে এনেছিলেন। এরপর নানা রকমের বাধা–বিপত্তি এড়িয়ে বেশকিছু চমকপ্রদ আইন পাস করেছেন।
কিন্তু বাইডেনের একক মেয়াদে ক্ষমতা এখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে। বাইডেনের এ সময়কালকে একটিমাত্র দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হবে। সেটি হলো—বয়স নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ উপেক্ষা করা ও ২০২৪ সালে আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
৪৬তম এ মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথা উঠলে অনেকের মাথায় বিপর্যস্ত চেহারার বাইডেনের মুখ ভেসে ওঠে, যিনি ট্রাম্পের সঙ্গে নির্বাচনী বিতর্কে খুব বাজেভাবে হেরে যান। সে সময় তেমন কোনো কথাই বলতে পারেননি তিনি। এর ফলে বয়স নিয়ে বিতর্ক চাঙা হয়ে শেষমেশ নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য হন তিনি।
পরে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে বাইডেনের স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। নির্বাচনী প্রচারের মাঝামাঝি এসে ও আকস্মিক প্রার্থী হয়ে তাঁর জন্য ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব ছিল।
বাইডেন এখনো স্বীকার করেন যে তিনি যদি শেষ পর্যন্ত তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করার জেদ করতেন, তাহলে নিজের সুনাম ফিরিয়ে আনতে হয়তো একটু সময় লাগত।
বাইডেন তাঁর বিদায়ী ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা একসঙ্গে যা করেছি, তার পরিপূর্ণ প্রভাব অনুভব করতে সময় লাগবে। কিন্তু এর বীজ রোপণ করা হয়েছে।’
২০২১ সালের জানুয়ারিতে জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ ছিল প্রায়ই অবমূল্যায়নের শিকার হওয়া একজন রাজনীতিবিদের জন্য এক অসাধারণ প্রত্যাবর্তন; যিনি সারা জীবন রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ও ব্যক্তিগত জটিলতা—উভয়টির সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু তিনিই একপর্যায়ে দলের জন্য ‘ত্রাণকর্তা’ হয়ে উঠেছিলেন।
২০২৪ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত বাইডেন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি প্রসিদ্ধ।
বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের পরাজয় অস্বীকার করে দেশটির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালান তাঁর বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে দেশটি। একই সময় কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল।
কিন্তু বাইডেন দ্রুত কংগ্রেসের মাধ্যমে একটি বিশাল মহামারি পুনরুদ্ধার প্রকল্প ও বড় অঙ্কের ‘সবুজ বিনিয়োগ’ পরিকল্পনা হাতে নেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও অবকাঠামো খাতকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয় ও নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে নিযুক্ত করেছিলেন জো বাইডেন।
পশ্চিমা মিত্ররা তাদের জোটের প্রতি বাইডেনের প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানিয়েছিল, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে নষ্ট করেছিলেন।
সম্ভবত বাইডেনের সবচেয়ে গর্বিত অর্জন ছিল ২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করা ও ২০২৩ সালে কিয়েভে তাঁর গোপন সফর।
কিন্তু ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে বিশৃঙ্খলভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করে। এর পর আর জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি তিনি। সিএনএনের সর্বশেষ জরিপে তাঁর প্রতি অনুমোদনের রেটিং ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ।
কোভিড মহামারির প্রভাব কমাতে বাইডেনের দেওয়া প্রণোদনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের পেছনে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাইডেন সীমান্ত নীতি শিথিল করায় দেশটিতে ব্যাপক হারে অবৈধ অভিবাসন বেড়ে গেছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে কমলা হ্যারিসকে ঘায়েল করতে এ বিষয়টি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ট্রাম্প।
বাইডেন দাবি করেছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর মেয়াদকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু গাজায় হাজারো মানুষকে হত্যা সত্ত্বেও হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতি তাঁর অবিচল সমর্থন অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে।
এত সবের পরও বাইডেন বিশ্বাস করতেন যে, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আবার ট্রাম্পকে পরাজিত করতে পারেন।
১৯৭২ সালে ২৯ বছর বয়সে মার্কিন সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন পরেই বাইডেনের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ও শিশুকন্যা নিহত হয়। এরপর তিনি জিল বাইডেনকে বিয়ে করেন। ২০১৫ সালে মস্তিষ্কের ক্যানসারে তাঁর বড় ছেলে বিউর মৃত্যু হয় এবং ছোট ছেলে হান্টার বাইডেন মাদক ও আইনি সমস্যার মুখে পড়েন। তাঁকে বিতর্কিতভাবে ক্ষমা করে দিয়েছেন বাইডেন।
কিন্তু বয়স এমন একটি যুদ্ধ ছিল, যা বাইডেন জিততে পারেননি। ট্রাম্প বাইডেনকে ‘ঘুমকাতুরে জো’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এয়ার ফোর্স ওয়ানের সিঁড়িতে কিংবা বাইক থেকে নামার সময় বাইডেনের প্রতিবার হোঁচট খাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অব্যাহতভাবে প্রচার হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারা এবং ২০২৩ সালে পুনরায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর বাইডেনের ওপর রিপাবলিকানদের আক্রমণ ও ডেমোক্র্যাটদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
অথচ হোয়াইট হাউস ‘কোনো সমস্যা নেই’, এ কথার ওপর জোর দিয়েছে ও বাইডেনকে ক্রমেই বেশি সুরক্ষা দিয়েছে—যতক্ষণ না অনেক দেরি হয়ে গেছে।
যাহোক, ক্ষমতার শেষ দিনগুলোয় ট্রাম্পের কাছে মসৃণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ তৈরি করেছেন বাইডেন, যা ট্রাম্প করেননি। বাইডেন ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রশ্নে নজিরবিহীনভাবে সহযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।
যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিদায়ী ভাষণে বাইডেন ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন ও যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিপজ্জনক গোষ্ঠী শাসন গড়ে উঠছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।