পাকিস্তানের ৬ স্থানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আকাশ ও স্থলে জবাব ইসলামাবাদের
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 07-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

কাশ্মীরে হামলা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তানের ছয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এসব হামলায় অন্তত ৮ জন নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়েছেন। এর জবাবে রাতেই পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা হামলায় অংশ নেওয়া ভারতের পাঁচটি জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করেছে। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেডের সদর দপ্তর ও তল্লাশিচৌকিও গুঁড়িয় দেওয়ার দাবি করেছে তারা।

ভারতের সেনাবাহিনী বলেছে, কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গোলার আঘাতে তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

ভারতের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আখ্যায়িত করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। এর সমুচিত জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের হামলাকে ‘হতাশাজনক’ বলেছেন। শিগগির এই সংকটের সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

সংঘাতপূর্ণ এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিশ্ব নিতে পারবে না বলে সতর্ক করেছেন তিনি। উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

 

 

ভারত প্রতিবেশী দেশটিতে এই হামলা চালিয়েছে গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার জেরে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সে কারণে তাদের এই হামলা চালাতে হয়েছে।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লাহোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের মুরিদকের সড়কে ট্রাকের ওপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্যাংক। ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরদিন এই চিত্র দেখা গেছে। ৭ মে, ২০২৫  

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লাহোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের মুরিদকের সড়কে ট্রাকের ওপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর ট্যাংক। ভারত পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরদিন এই চিত্র দেখা গেছে। ৭ মে, ২০২৫ছবি: এএফপি

ভারত এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় গতকাল দিবাগত রাত একটার পর। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে এই অভিযান চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। এর আওতায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের নয়টি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।

পাকিস্তানের ছয় স্থান—পাঞ্জাবের শিয়ালকোট, ভাওয়ালপুর ও মুরিদকে এবং পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদ, বাগ ও কোটলি শহরে একের পর এক ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।

ভারতের সেনাবাহিনী বলেছে, তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কোনো স্থাপনায় হামলা চালায়নি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআই জানিয়েছে, ভাওয়ালপুরে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ–ই–মোহাম্মদের প্রধান কার্যালয় , মুরিদকে শহরে পাকিস্তানভিত্তিক আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী লস্কর–ই–তাইয়েবার প্রধান কার্যালয়সহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানায় এসব হামলা চালিয়েছে।

 

কাশ্মীরে হামলার পর দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট ওরফে কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স নামের একটি গোষ্ঠী ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। যদিও পরে তারা তা অস্বীকার করে। ধারণা করা হয়, এই গোষ্ঠীর সঙ্গে লস্কর-ই-তাইয়েবার সম্পর্ক রয়েছে।

ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর প্রথম প্রকাশ করেন পাকিস্তানের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী। রাত একটার পর পাকিস্তানের এআরউয়াই নিউজকে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে কিছু সময় আগে কাপুরুষ শত্রু ভারত ভাওয়ালপুরের আহমেদ ইস্ট এলাকার সুবহান্নাল্লাহ মসজিদ, কোটলি ও মুজাফ্ফরবাদের অন্তত তিন জায়গায় বিমান হামলা চালিয়েছে।’ পরে অন্য এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হওয়ার কথা জানায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

 

এসব ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের আকাশসীমা থেকে নিক্ষেপ করা হয় বলে পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক জানান। তখনই তিনি বলেন, ভারতের এই হামলার জবাব দেওয়া হচ্ছে। এরপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘কোনো উসকানি ছাড়া ভারতের এই হামলার সুনির্দিষ্ট জবাব দেওয়ার পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানের আছে এবং উপযুক্ত জবাব দেওয়া হচ্ছে।’

এর কিছুক্ষণ পর রাত পৌনে তিনটার দিকে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার জানান, দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের দুটি জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করেছে। এর ঘণ্টাখানেক পর ভারতের তৃতীয় জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার খবর দেয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন পিটিভি। বলা হয়, ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অবন্তিপুরার ১৭ নটিক্যাল দক্ষিণ–পশ্চিমে ভারতের আরেকটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী।

এর মধ্যে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রের বরাত দিয়ে দেশটির সম্প্রচারমাধ্যম জিও নিউজ জানায়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় ধুনদিয়াল সেক্টরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেডের সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

ভোর চারটার দিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৮ জন নিহত, ৩৫ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ হওয়ার কথা জানায়। এর এক ঘণ্টা পরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও তথ্যমন্ত্রী ভারতের চতুর্থ ও পঞ্চম জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করার কথা জানান।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ভূপাতিত করা পাঁচটি ভারতীয় জঙ্গি বিমানের মধ্যে তিনটি রাফাল, একটি রাশিয়ান এসইউ–৩০ ও আরেকটি মিগ–২৯ জঙ্গি বিমান।

 

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, পাকিস্তানে হামলা চালানোর পরই এসব ভারতীয় বিমানকে ভূপাতিত করা হয়েছে।

যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার বিষয়ে ভারতের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এটা হয়ে থাকলে তা কয়েক দশকের মধ্যে ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে।

 

ভারতীয় হামলায় ক্ষয়ক্ষতি

পাকিস্তানের লাহোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে মুরিদকে এলাকায় এই পাকিস্তানি পরিবারটির বসবাস। দেশটির মাটিতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বাড়ি খালি করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জড়ো হয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ৭ মে ২০২৫

পাকিস্তানের লাহোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে মুরিদকে এলাকায় এই পাকিস্তানি পরিবারটির বসবাস। দেশটির মাটিতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বাড়ি খালি করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জড়ো হয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ৭ মে ২০২৫ছবি: এএফপি

ভোরে এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানান, ভারত পাকিস্তানের ছয়টি লোকালয়ে মোট ২৪টি হামলা করেছে। হামলায় তারা বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এসব হামলায় ৮ জন পাকিস্তানি নিহত, ৩৫ জন আহত হয়েছেন এবং ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানান, আজাদ কাশ্মীরের ভাওয়ালপুরের আহমেদপুর ইস্টের সুবহান মসজিদে হামলা হয়েছে। সেখানে চারটি হামলা হয়েছে এবং পাঁচজন পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন বছরের এক কন্যাশিশু রয়েছে। এ ছাড়া সেখানে ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী।

আইএসপিআরের মহাপরিচালক জানান, হামলায় একটি মসজিদ এবং চারটি আবাসিক ঘর ধ্বংস হয়েছে।

আজাদ কাশ্মীরের মুজাফ্ফারাবাদের বিলাল মসজিদে হামলা হয়েছে জানিয়েছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, সেখানে সাত দফায় হামলা হয়েছে। এতে একটি মসজিদ ধ্বংস এবং এক কন্যাশিশু আহত হয়েছে।

এই অঞ্চলের আরেক শহর কোটলির আব্বাত মসজিদে হামলা হয়েছে। সেখানে পাঁচটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং দুজন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে ১৬ বছরের এক কিশোরী ও ১৮ বছরের এক তরুণ রয়েছে। এক নারী ও তাঁর শিশুকন্যা আহত হয়েছে।

পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক জানান, পাঞ্জাবের মুরিদকে শহরে উমালকুরা মসজিদে চার দফা ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। সেখানে একজন নিহত এবং আরেকজন আহত হয়েছেন। এই জায়গায় দুই ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে একটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে এবং ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

এই প্রদেশের আরেক জেলা শিয়ালকোটের কোটকি লোহারা গ্রামে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এখানে একটি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং আরেকটি খোলা মাঠে পড়ে। তাতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

এই অঞ্চলের শাখারগড়ে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। তবে একটি ওষুধের দোকানে সামান্য ক্ষতি ছাড়া তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙেছে

পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একটি জায়গার আশপাশের বাসিন্দারা প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসেন। ৭ মে, ২০২৫

পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একটি জায়গার আশপাশের বাসিন্দারা প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আসেন। ৭ মে, ২০২৫ছবি: এএফপি

পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুজাফ্ফরাবাদে গভীর রাতে বড় ধরনের একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বিবিসিকে তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একটি সম্ভাব্য নিশানা ছিল মুজাফ্ফরাবাদের বিলাল মসজিদ। ওই মসজিদের পাশেই বসবাস করেন মোহাম্মদ ওয়াহিদ। তিনি বলেন, ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল, এমন সময় প্রথম বিস্ফোরণে আমার বাড়িটা কেঁপে ওঠে। আমি দৌড়ে রাস্তায় বের হই। সেখানে দেখি অন্যরাও একই কাজ করছে। আমরা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি কী হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানলে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।’

ওয়াহিদ বলেন, ডজনখানেক মানুষ আহত হয়েছেন এবং তাঁদের প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

ওই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ওয়াহিদ বলেন, ‘বাচ্চারা কাঁদছে, নারীরা দৌড়াদৌড়ি করছে, তারা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা জানিই না কী করব। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, আর চারদিকে এক অজানা অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।’

এই পাকিস্তানি জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না একটি মসজিদ কেন হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো।

ওয়াহিদ বলেন, ‘এটা তো সাধারণ একটা মসজিদ ছিল, যেখানে আমরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তাম। আমরা এই মসজিদ ঘিরে কখনো সন্দেহজনক কিছু দেখিনি।’

শেয়ার করুন