যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বনেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ দৌড়ে কেউ ইউক্রেনের ধারেকাছে নেই।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর নববর্ষের ভাষণে বলেছেন, ‘পুতিনের আগ্রাসনের অবসান ঘটাতে এবং শান্তি অর্জনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সক্ষমতা ও ইচ্ছা নিয়ে [আমার] কোনো সন্দেহ নেই।’ এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের মন জয় করার ব্যাপারে জেলেনস্কির মনোভাব ফুটে উঠেছে।
এর কয়েক দিন পর জেলেনস্কি মার্কিন এক পডকাস্টারকে বলেন, কমলা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্প ‘বেশি শক্তিশালী’। এ কারণে তিনি জিতেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, ট্রাম্প দেখিয়েছেন, তিনি এটা বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক—উভয়ভাবে করতে পারেন।
ইউক্রেনের যেসব প্রখ্যাত ব্যক্তি ট্রাম্পের তোষামোদ করছেন, তাঁদের মধ্যে জেলেনস্কি কিন্তু একা নন। গত নভেম্বরে জেলেনস্কির পার্টির এক পার্লামেন্ট সদস্য ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। ইউক্রেনের সংবাদপত্র কিয়েভ ইনডিপেনডেন্টের সাংবাদিকেরা ওই চিঠি দেখেছেন।
ট্রাম্পকে তোষামোদ করাটা ইউক্রেনের জন্য নতুন কোনো কৌশল নয়। ২০১৯ সালে সিএনএনে লেখা এক প্রবন্ধে ট্রাম্পকে ‘মহান শিক্ষক’ বলেছিলেন জেলেনস্কি। তখন জো বাইডেন ও তাঁর ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা ট্রাম্প।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে তিন বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন ইউক্রেনের দুর্দশা অব্যাহত থাকতে পারে না। ২০২৫ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন কোণঠাসা অবস্থায় চলে গেছে। পূর্ব দিকে রুশদের অগ্রগতি ঠেকাতে ইউক্রেনের সেনারা খাবি খাচ্ছেন, সেখানে ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়ার সেনাসংখ্যা অনেক বেশি। রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলো দেশটি সহসা উদ্ধার করতে পারবে, এ সম্ভাবনাও ক্রমশ কমে আসছে।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে ইউক্রেনকে এককভাবে বৃহত্তম সামরিক সহায়তা দানকারী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে হলে ট্রাম্পের মন পাওয়া যে জরুরি, এ বিষয়ে কিয়েভ ভালোভাবে সচেতন।
ডি-৩০ হাউইটজার কামান থেকে গোলা ছুড়ছেন রাশিয়ার সেনারা। ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে, ১১ জানুয়ারি ২০২৫ছবি : রয়টার্স
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের নীতিবিষয়ক ফেলো জোয়ানা হোসা বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ট্রাম্পের প্রতি দ্রোহী মনোভাব পোষণের সামর্থ্য জেলেনস্কির নেই। ইউক্রেনের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভালো ফলের জন্য তিনি অন্তত ট্রাম্পকে ইউক্রেনের পাশে পাওয়ার চেষ্টা করবেন। [ইউক্রেনের সম্ভাব্য ভালো ফলের বিষয়টি] মোটাদাগে আমেরিকার সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে ট্রাম্প বারবার জোর দিয়েছেন। যুদ্ধ সমাপ্তির আলাপ-আলোচনা বেশি দূরে নয় বলেও তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির বিষয়ে ট্রাম্পের দূতের পরিকল্পনা ক্রেমলিনের পক্ষেই যাবে।
এরই মধ্যে জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘সরাসরি কাজ করতে’ চান। তাঁর এ মনোভাব এ বিষয়ের ইঙ্গিত দেয় যে তিনি যুদ্ধের বিষয়ে আরও ছাড় চান, অথবা এমনটি করা ছাড়া তাঁর উপায় নেই।
জোয়ানা হোসা বলেন, ‘অবশ্যই ইউক্রেন নিজেদের হারানো সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চাইবে। কিন্তু তিন বছরের এই বিধ্বস্ত যুদ্ধের পর সব ভূখণ্ডের পুনরুদ্ধার সহসা সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের মানুষ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এটা মেনে নিচ্ছেন।’
জেলেনস্কি সম্প্রতি ট্রাম্পকে বারবার শক্তিশালী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁকে এভাবে বর্ণনা করার মধ্যে একধরনের আকুতি রয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ অর্জনের জন্য পরিচিত।
লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের উপপরিচালক ওরিসিয়া লুটসেভিচ মনে করেন, জেলেনস্কির উপর্যুপরি ট্রাম্পবন্দনাকে ব্যাপক অর্থে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া যায়। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, তিনি [জেলেনস্কি] সত্যিই মনে করেন ট্রাম্প শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে পারেন। আর এখান [এ ধারণা] থেকেই আশা দেখা যাচ্ছে। শুধু জেলেনস্কির মনে নয়, ব্যাপক অর্থে পুরো ইউক্রেন [এই আশা দেখছে]।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির রামস্টেইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বিমানঘাঁটিতে, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ছবি : এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক ছিল বৈরী। পুতিনকে ‘কসাই’ বলে নিন্দা করেছিলেন বাইডেন। কিন্তু পুতিনের সঙ্গে নিজের ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন ট্রাম্প। বিশ্বের অন্য নেতারা পুতিনকে এড়িয়ে চললেও দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্প তাঁর প্রশংসা করে আসছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘খুব দ্রুত’ পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
আপাতদৃষ্টে মনে হয়, ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে পুতিনের কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচনে জয়ের পর পুতিন ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁকে ‘সাহসী মানুষ’ বলে মন্তব্য করেছেন। গত ডিসেম্বরে বছরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে প্রস্তুত।
কিন্তু আলোচনার টেবিলে ফিরলেও রাশিয়াকে বিশ্বাস করা যায় না। সিএনএনের প্রধান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংবাদদাতা নিক প্যাটন ওয়ালশ বলেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাশিয়ার আগের প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল প্রতারণাপূর্ণ। তাই সম্ভাব্য কোনো যুদ্ধবিরতি কেবল নামমাত্রই হবে বলে মনে হচ্ছে।
ওরিসিয়া লুটসেভিচ মনে করেন, ইউক্রেন সরকার মস্কোর কাছে কিয়েভের পরাজয়কে এমন একটি বিষয় হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করছে, যা বিশ্বমঞ্চে ‘আমেরিকার সামর্থ্যকে’ শক্তিশালী করবে না।
কিন্তু চ্যাথাম হাউসের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘[ইউক্রেনের এই চেষ্টা] একধরনের খেলা, ট্রাম্প সেটাকে কার্যকর কৌশল মনে করেন কি না, সেটা অন্য আরেকটি প্রশ্ন।’
জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যান্য প্রলোভনও দেখিয়েছেন। গত বছরের অক্টোবরে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হলে ইউরোপে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সেনার সঙ্গে ইউক্রেনের সেনার বিনিময় করার কথা তুলেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা ভালো কাজে লাগানো যেতে পারে, তা ন্যাটোকে শক্তিশালী করবে এবং ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। জেলেনিস্কার এ প্রস্তাব ট্রাম্পের কাছে লোভনীয় হতে পারে। কারণ, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে ইউরোপের দেশগুলোকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে বলে আসছেন। এ ক্ষেত্রে জেলেনস্কির প্রস্তাব সহায়তা করতে পারে।
ইউক্রেনের এই সেনাসদস্য তাঁর ইউনিট থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর তিনি আবার ফিরে এসেছেন। ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের পোকরোভস্ক শহরে, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স
ট্রাম্পের ব্যবসায়িক মনকেও প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেছেন জেলেনস্কি। গত বছরের অক্টোবরে জেলেনস্কি তথাকথিত ‘বিজয় পরিকল্পনা’ প্রকাশ করেছিলেন। এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের খনিজ পদার্থ নিয়ে চুক্তি করার কথা বলা হয়েছে। ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের বড় উৎস।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন ও কিয়েভের মধ্যে খনিজ পদার্থবিষয়ক চুক্তি এখন পর্যন্ত দুবার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্পই যাতে এই চুক্তির কৃতিত্ব নিতে পারেন, সেই জন্যই তা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এ ছাড়া কিয়েভ এমন প্রস্তাব দিতে পারে, যা অর্থনৈতিক বিচারে ওয়াশিংটনের জন্য বেশ লোভনীয় হতে পারে বলে মনে করেন ওরিসিয়া লুটসেভিচ। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিজয় পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখেছি। ... [ইউক্রেন] মূলত বলতে চাইছে, এটা আমেরিকার জন্য লাভজনক হবে।’
জেলেনস্কির কৌশল সার্থক হচ্ছে বলে মনে করেন ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের নীতিবিষয়ক ফেলো জোয়ানা হোসা। কারণ, এরই মধ্যে ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, ইউক্রেন সংকট সমাধান করতে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। এটা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন সংকট সমাধানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জোয়ানা হোসা বলেন, ‘তিনি [জেলেনস্কি] এখন দুটি বিকল্পের মুখোমুখি: তাঁকে হয়তো ট্রাম্পের তোষামোদি করতে হবে, অথবা পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে তাঁকে বাধ্য করা হতে পারে। তবে [আত্মসমর্পণের চেয়ে] ভালো ফলের জন্য তোষামোদ তেমন একটা মন্দ নয়।’