আজ ২৯ এপ্রিল ১৯৮৬ সালের এই দিনে সীমান্ত সংলগ্ন পানছড়ি, তবলছড়ি, আসালং, শনটিলা, ফাতেমা নগর, মাটিরাঙ্গার ৬টি বাঙালী বসতির উপর শান্তি বাহিনী নৃশংসতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত নিরীহ গ্রামবাসীদের এক যোগে হামলা চালিয়ে অসংখ্য নারী, শিশু, বৃদ্ধ যুবকদের হত্যা করে, লাশ সেসব ঘরে রেখেই পুড়িয়ে দেয়।
এ আক্রমণ ছিলো হঠাৎ এবং খুবই পরিকল্পিত। ১৯৮৩ সালে শান্তিবাহিনীর নিজেদের আন্তঃকোন্দলের শিকার হয়ে সন্তুর অগ্রজ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হলে তাদের দলে তীব্র ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ শুরু হয়। সাধারণ পাহাড়ি এই বিরোধের মধ্যে পড়ে অসহায়বোধ করতে থাকে। পার্টির প্রতি জনসমর্থন ধরে রাখতে এবং নিজেদের প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে তারা ভিন্ন কৌশল বেছে নেয়।
আর তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সদ্য পুনর্বাসিত বাঙালী যাদের কে বিভিন্ন নদী ভাঙ্গন এলাকা থেকে পাহাড়ের খাস জমিতে বসতি গড়তে আনা হয় তাদেরকে নির্মূল করা।
এতো কয়েকটি লক্ষ্য স্হির করা হয়ঃ
১. বাঙালী পুনর্বাসন কে নৃশংসতা দিয়ে ঠেকানো।
২. এর মাধ্যমে স্হানীয় জনগনের বিভক্ত সমর্থন কে নিজেদের অনুকূলে আনা।
৩. নৃশংসতার হার কে এমন উচ্চতায় আনা যেন তা বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সরকারের উপর চাপ বাড়ে।
৪. বাঙালীর পাল্টা আক্রমণ হলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরন এবং এর মাধ্যমে ভারতকে সম্পৃক্ত করা।
৫. সেনাবাহিনী কে বাঙালী সুরক্ষার কাজে বেশি ব্যস্ত রেখে সন্তু লারমা তাঁর প্রতিপক্ষ প্রীতি গ্রুপকে দমন করতে সুবিধা পাওয়া।
এ যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার সেই খনার আমলের চানক্য কৌশল!
পরিকল্পনা মাফিক রাতে ভারত সীমান্তবর্তী গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে পরে ঘাতক শান্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল। তারা রাতের আঁধারে বিভিন্ন বাঙালী গ্রামগুলোর চারপাশে অবস্থান নেয়। রমজানের ইফতার ও রাতের খাবার খেয়ে গ্রামগুলোর অধিবাসীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
মধ্য রাতরে নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ে শান্তি বাহিনীর অস্ত্রের গর্জনে। প্রায় অরক্ষিত নিরাপত্তা বলয়হীন গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙে যায় গুলির শব্দে।
টাঙ্গাইলের যমুনা তীরবর্তী নদী সিকিস্তি এলাকা থেকে আসা যুবক শরাফতের বাড়ি ফাতেমা নগর নামে পরিচিত টিলার উপর। অন্ধকারে হাতড়ে তার পাশে ঘুমন্ত স্ত্রী কে জাগিয়ে তুলে। ওকে ঘর থেকে বের হতে নির্দেশ দিয়ে ঘুমন্ত এক কন্যাকে বগলের নীচে নিয়ে দরজা ঠেলে বের হতেই অন্ধকারে ঘাতক শান্তি বাহিনীর কয়েকজনের গুলির সম্মুখীন হয়। কারা আক্রমণকারী সে বুঝে উঠতে পারে না। এরা কি ডাকাত দল?
বাঁচার শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে গুলি উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশের খাদে। তার ভাগ্য ভালো, গুলি তাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু অতটা ভাগ্যবান ছিলো না তার বছর খানেক বয়সের কন্যা শিশু। একটি গুলি ওর পেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। ঝোপের ভিতর বেত কাটাঁর আঘাতে তার দেহ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। লুকিয়ে থাকে সেখানে। হঠাৎ খেয়াল করে তার পেটে গরম এক অনূভতি। নিজ কন্যার নাড়িভুড়ি তার পেটে লেগে যাওয়ায় সেই গরম অনুভূতি। তার মেয়ে তার বাহু লংগ্ন হয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
শরাফত তার স্ত্রী ও অপরাপর দুই সন্তানের কথা ভাবতে থাকে। ওর ভাবনা ভয়ংকর রূপ নেয় যখন আগুনের লেলিহান শিখা রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে উর্ধাকাশ আলোকিত করে তুলে। বাঁশ ছনের আগুনের উওাপ সে ঝোপের ভেতর বসেও পাচ্ছিলো। আগুনের তাপে বাঁশের গিটগুলো 'টাস টাস ' শব্দ করে ফুটছিলো। স্ত্রী ও বাকি সন্তানের বেচেঁ থাকার চিন্তা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো-' ওরা কি ঘর হতে বের হতে পারছে?'
কিশোর বয়সে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর হাতে ওদের টাঙ্গাইলের বাড়ি পুড়তে দেখেছে সে। যমুনার ভাঙনে ওদের জমি পানিতে গেছে। বাঁধ হয়ে উঠেছিলো তাদের ঠিকানা। আজ স্বাধীন দেশে এ কোন হানাদার??
সকালের আলো ফোঁটার অনেক পর নিজের লুংগী ছিঁড়ে কন্যার নাড়িভুড়ি কে পেটে ঢুকিয়ে বাঁধন দেয়। তারপর ছড়া ধরে রওনা হয় পানছড়ি বাজারে দিকে। সদর স্কুল প্রাঙ্গনে জড়ো হয় অনেক ভীত সন্ত্রস্ত বাঙালী পরিবার। তারা এতটাই ভীত ছিলো যে কেউ কাঁদেনি।
"স্যার, ঐ যে দেখছেন মাঠ, ঐ মাঠের পশ্চিম কোনায় আমার পরিবারের সকলের কবর- তিন সন্তান আর স্ত্রী সহ চারজন। আমিও শুধু বেচেঁ আছি। আমার সাথে যারা টাঙ্গাইল থেকে এসেছিলো সবাই পাহাড়ের মাটিতে শেষ আশ্রয় নিয়েছে। আমার আজকের পরিবার ও সন্তানাদি এই পাহাড়ের। "
শরাফত ছিলো দারুন শক্ত-পোক্ত এক যুবক। শরাফত কাঠুরিয়া নামে তাকে সকলেই জানে। আজও (২০০৩) ওর শরীরের পেশীগুলো যথেষ্ট পাকানো। বড় বড় সব গাছ অনায়াসে তুলে নেয় কাঠের পাটাতনের উপর। তারপর কালো ধারালো দাঁতওয়ালা করাতের সাহায্যে চিঁড়ে ফেলে তক্তার আদলে।
মধ্য দুপুরের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সে রওনা হয় তার অবশিষ্ট পরিবারের খোঁজে। তার সাথে বেঁচে যাওয়া আরো অনেকেই।
তখন স্পষ্ট হতে থাকে শান্তিবাহিনীর নৃশংসতার চিত্র। ফাতেমা নগরের টিলার উপর ঘরগুলো থেকে তখনো আধা নির্বাপিত আগুন থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী বের হচ্ছে। শরাফত তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দ্রুত নগ্ন হাতে আছড়ে আছড়ে কয়লা ছাই সরিয়ে বের করে আনলো তার স্ত্রীর পোড়া দেহ। ঘরের পাশের কলা গাছগুলো থেকে অর্ধপোড়া পাতা ছিড়েঁ নগ্ন দেহটাকে ঢেকে দিলো। দগ্ধ চৌকির পাটাতনের নীচে মিললো বড় ছেলেটা লাশ- বুলেট বিদ্ধ পোড়া এক পাশ। এতক্ষণ পর্যন্ত সে স্হীর ছিলো। কিন্তু যখন তার তিন বছর বয়সী দ্বিতীয় কন্যার লাশটি দেখলো তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার অজান্তে - গলায় কোপ খাওয়া পোড়া লাশ। সন্তুর রক্তপিপাসু শান্তি বাহিনীর হায়েনারা গুলি খরচ করেনি- দায়ের কোপে দ্বিখণ্ডিত করার পর জ্বলন্ত ঘরে ছুড়ে ফেলেছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বপনের জুম্ম দেশ গড়ার লক্ষ্যে।
পরদিন (৩০ এপ্রিল) সারাদিন সীমান্তবর্তী বাঙালী গ্রাম গুলো থেকে চাঁদের গাড়ী ভরে ভরে পোড়া অর্ধপোড়া লাশ জমা হতে থাকে পানছড়ি সদর স্কুল প্রাঙ্গনে। সদর সংলগ্ন মাঠে তাদের সমাহিত করা হয়।
সন্ধ্যায় শরাফত ভীষণ একা হয়ে ভাবতে থাকে, তার আর রইলো কি বাকী! এভাবে তো সবাই কে মরতে হবে দেখছি! নিজের জীবন কে তার তুচ্ছ মনে হয়। যদি মরতেই হয় তবে মেরেই মরবো।
প্রতি হিংসার অনল জ্বলে উঠে মনে।
পরদিন তার ভাবনার সাথে যোগ দেয় আরো অনেকে- "রক্তের বদলা রক্ত"!!
বাজারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের দোকানে চলে কি করে এর পাল্টা জবাব দেওয়া যায়!
সংঘবদ্ধ বাঙালীর সম্মিলিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ না দেখালে বাকীরাও পরের ধাপে মরবে। আশংকা করে তারা। বাজারে পাহাড়িদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। নিমিষে তারা অজানা আতংকে মিলিয়ে গেছে যেন। তারাও কেউ কেউ আশংকা করেছিলো ভয়ংকর পাল্টা কিছু ঘটতে পারে।
শরাফতরা তাদের কয়েকটি দলে ভাগ করে নেয়ঃ বাজার চৌধুরী - বাজার সংলগ্ন পাড়া- সূতাকর্ম পাড়া- নালকাটা। অস্ত্র বলতে দা - কুড়াল - ছেনী- সড়কি।
" স্যার, আমি প্রথম আঘাত করি বাজার চৌধুরী ও তার বউ কে। এদের দুজনকে কোপানোর পর আমি রক্ত দেখে কেমন যেন হয়ে যাই, আমার মনে হলো আমি যেন কচু কাটতেছি মানুষ নয়"-এভাবেই ঘটনার ১৪ বছর পর আমার কাছে সে দিনের ঘটনাক্রম বর্ননা করে।
আমি বাজার চৌধুরী কে চিনতাম, তবুও তাকে কোপাই "।
একটা "মব মেন্টালিটি" সবাইকে পেয়ে বসে। প্রথম ধাক্কায় যা ক্ষয়ক্ষতি হয় পাহাড়িদের বিশেষ করে চাকমা পাড়াগুলোতে। এরপর দিক বিদিক সবাই ছুটে যায় সীমান্তের দিকে। শান্তি বাহিনীর লক্ষ্য অর্জন হয়।
একজন প্রাক্তন মেম্বার শান্তি কুমারের কাছে যানতে চাই 'গ্রেট নালকাটা কিলিং' র তার অভিজ্ঞতার কথা।
তার ভাষ্যঃ " বাঙালীদের উপর আঘাত আমাদেরকে শেষ মেষ নিঃস্ব করে ছেড়েছে। আমাদেরকে পার্টি তরফ থেকে পুঁজগাও ডেকে নিয়ে বলা হয়েছে এলাকা ছেড়ে যেতে, ফেনী নদী পার হয়ে ওপারের শিবিরে আশ্রয় নিতে। কেউ কেউ কথা শুনেছে, আমরা অনেকেই শুনিনি, কারন যত শংকাই থাকুক নিজ ভিটে মাটি ছেড়ে কেউ যেতে চায় না।
" আমরা সেটেলার কাটবো, তার পাল্টা হিসাবে বাঙালী তোমাদের কাটতে আসবে, তোমরা এর জন্য দায়ী হবা, পার্টি দায় নেবে না।"- এসব ছিলো পার্টির লাইন।
এরপর পাহাড়িরা অনেকটা গোপনে কোন কোন জমি বাঙালির কাছে বর্গা দিয়ে চলে গেছে। অনেকগুলো পানির দামে গরু ছাগল বিক্রি করেছে বাঙালী কসাইদের কাছে। দশ হাজার টাকার গরু ২ হাজারে বিক্রি করেছে। এসবই ছিলো আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস।
" ছিয়াশির কাটাকাটি আমাদের অনেকের কোমড় ভেঙে দিয়েছে, চুক্তির পর যারা জমি লীজ দিয়েছিলো তারা অনেকেই জমি পায়নি আর"
শিবিরের মধ্যে অনেক দুঃখের মধ্যে কাটাতে হয়েছে, সেটা পার্টির নেতারা বুঝলেও আমাদের ফেরত আসতে দেয়নি। বলে, "জাদর জন্য ত্যাগী না অলে জাদর মুক্তি নাই "।
এই চাকমা জাতির মুক্তির জন্য ১৯৭৩ সালে সন্তু লারমা দিঘীনালার গাছে গাছে পোস্টারে ভরে দিয়েছিলেন-
" বাঙালির রক্ত নিবা, পাহাড়িরা স্বাধীন হবা"
"পাহাড়িরা অস্ত্র ধর, বাঙালীরা পাহাড় ছাড়ো"
বাঙালী পুনর্বাসনের (১৯৭৮-৭৯) বহু আগেই সন্তু লারমা বাঙালীর রক্ত দিয়ে তার সংগ্রামের যে মেনিফেস্টো লিখে ছিলেন তার ব্যাপক বাস্তবায়ন করেনে ১৯৮৬ সাল থেকে।
তার সেই মেনিফেস্টো হাজার হাজার বাঙালী রক্ত দিয়ে ব্যর্থ করে দিয়েছে। তাই আজ হতাশা গ্রস্হ সন্তু লারমার কন্ঠে শুনি পতিত কমিউনিস্টের আর্তনাদঃ
" আমরা কার কাছে যাবো
কোথায় যেয়ে দাড়াবো?"
( মুক্তি যুদ্ধের যাদুঘর মিলয়াতন, আগাঁরগাও ২৮ এপ্রিল ২০২৩ এ প্রদও বক্তব্য)
শরাফত কাঠুরিয়া কে আমি এরকমই একটা প্রশ্ন করেছিলাম, " অনেকেই তো এসব খুনাখুনি সহ্য না করতে পেরে চলে গেছে, তুমি কেন রয়ে গেলে?"
উল্টাছড়ির স্কুল মাঠের পশ্চিমের ঢালে তার স্ত্রী - সন্তানদের কবরের দিকে তাকিয়ে সে অনেক উদাস কন্ঠে বলে,
" কেমন করে যাবো স্যার, ওরা তো সবাই এখানে। আমার পুরো পরিবারের রক্তে ভেজা এই মাটি, এই মাটির সাথে মিশে আছে সন্তানের গন্ধ।" সরকার দলিল দিছে কাগজে আমি বন্দোবস্তী নিছি লাশ দিয়ে।
" আমার লাশ ফিরিয়ে দিক আমি সরকারের জমি ফেরত দেব"!
শরাফত কাঠুরিয়ার এই দাবীর জন্য কোথায় দাড়াবে, কার কাছে যাবে সে প্রশ্নের কি জবাব দিবেন, অশীতিপর সন্তু লারমা???