পার্বত্য চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত করল্যাছড়িমুখ জুনিয়র হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত গণ-সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এম এন লারমা) অংশের নেতারা এসব অভিযোগ তুলে ধরেন।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়ে পাহাড়িদের কন্ঠরোধ করছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে পাহাড়ি নেতৃত্বকে অস্বীকার করার পথ বেছে নিয়েছে। পঁচিশ বছর আগের করা চুক্তি’র মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রেখে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অপ-প্রচার এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদে সরকারি দলের অনির্বাচিত ব্যক্তিদের বসিয়ে পাহাড়ে দুর্নীতি আর অনিয়মকে উস্কে দিচ্ছে স্বয়ং পার্বত্য মন্ত্রণালয়।
পাহাড়ের ভূমি সমস্যা নিরসনে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রনয়ণপূর্বক দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা, ভূমি বেদখল বন্ধ করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলােকে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কার্যকর রাখা, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার কার্যাবলী ও ক্ষমতা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করাসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে এই সমাবেশের আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
সাবেক ছাত্রনেতা প্রত্যয় চাকমা’র সঞ্চালনায় সূচিত সমাবেশে সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই তৃতীয়াংশ ধারাই অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
সংগঠনের নেতারা উদ্বেগে প্রকাশ করে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এক যুগের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আগের মতই পড়ে আছে।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক সুদর্শন চাকমা বলেন, আজকে পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উদযাপন করছি প্রতিবাদের সাথে। এতো বছর পরেও সরকার আমাদের ধারাগুলো অমীমাংসিত অবস্থায় ফেলে রেখেছে। এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন করে। তাহলে শান্তি ফিরে আসবে।
সমাবেশে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরণ এবং উক্ত পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন এর বিধিমালা চূড়ান্তকরণ, আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও তাদের নিজস্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন, অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন, চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশােধন, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলাে বাস্তবায়নে সরকার অদ্যাবধি কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
সমাবেশে জেএসএস’র কেন্দ্রীয় সা. সম্পাদক ও মহালছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণ-সমাবেশে সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক প্রণব চাকমা, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’র ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক অমল চাকমা, খাগড়াছড়ি উপজাতীয় ঠিকাদার সমিতির সভাপতি রবি শংকর তালুকদার, জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুরেশ কান্তি চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সভাপতি প্রীতি খীসা, মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সা. সম্পাদক কাকলী খীসা, কেন্দ্রীয় যুব সমিতি’র সভাপতি জ্ঞানপ্রিয় চাকমা এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সুজন চাকমা বক্তব্য রাখেন।
এদিকে সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেছেন, পাহাড়ের মানুষ সারা বিশ্বে শান্তি ও সহাবস্থানে কি ভাবে থাকতে হয় তার নজির স্থাপন করেছেন। পাহাড়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা ধরে রাখতে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সম্প্রীতি ও এলাকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।
পরে তিনি বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজত জয়ন্তীর শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। শোভাযাত্রাটি জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে টাউন হলে গিয়ে শেষ হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জীবন ধারা তুলে ধরেন শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা।
শোভাযাত্রায় খাগড়াছড়ি রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু সহ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে কন্ঠ শিল্পী মমতাজ, হৃদয় খান সহ স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।