অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চেয়ে বেড়েছে বলে মনে করেন ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। আর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংবাদমাধ্যম আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মত দিয়েছেন ৬১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ।
ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার করা এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৩ থেকে ২৭ অক্টোবর দেশের আট বিভাগে ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ১ হাজার মানুষের মধ্যে জরিপটি করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলের মতো একই রকম স্বাধীনতা ভোগ করছেন বলে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন। আওয়ামী আমলের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম স্বাধীনতা ভোগ করছেন বলে জানিয়েছেন ১৪ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা। এ ব্যাপারে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা কথা বলতে চাননি।
পুরুষদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আগের সরকারের আমলের চেয়ে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে নিজেদের বেশি স্বাধীন বলে মত দিয়েছেন।
তরুণদের (১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী) মধ্যে ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তুলনায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বেশি বলে মনে করেন। আর ৩৫ বছর ও তার বেশি বয়সী উত্তরদাতাদের ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ মত দিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আগের আমলের চেয়ে বেশি।
গ্রামের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন আওয়ামী লীগ আমলের তুলনায় মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংবাদমাধ্যম আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মত দিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া ৬১ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগের ক্ষেত্রে এই দুই আমলের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে সংবাদমাধ্যম কম স্বাধীন বলে মনে করেন ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা।
৬ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা এ ব্যাপারে জানেন না বলে মত দিয়েছেন। এ ছাড়া শূন্য দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আওয়ামী লীগ আমলের তুলনায় সংবাদমাধ্যম অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছে বলে মনে করেন শহরের ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা। আর গ্রামের উত্তরদাতাদের মধ্যে এমন মত পোষণ করেন ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ।
তরুণদের (১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী) মধ্যে ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৩৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের তুলনায় সংবাদমাধ্যম অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে।
পুরুষদের মধ্যে ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আগের আমলের চেয়ে সংবাদমাধ্যম বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মত দিয়েছেন।
২০২৪ সালে প্রকাশিত সবশেষ মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। ২০০২ সাল থেকে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের এই অবস্থান সর্বনিম্ন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত প্রায় ১৫ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪৪ ধাপ পেছায় বাংলাদেশ।
সূচকে বাংলাদেশের এই অবনতির পেছনে যেসব কারণ বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—বিভিন্ন নিপীড়নমূলক আইন, দলীয় বিবেচনায় গণমাধ্যমের লাইসেন্স প্রদান, গণমাধ্যমকে একটি ভীতির মধ্যে রাখা।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনের মধ্যে অন্যতম। এই আইন কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও যেকোনো কারণে সাংবাদিকের সূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা অনুমোদন করে। এ ধরনের আইন বিদ্যমান থাকলে সম্পাদকেরা নিয়মিত নিজেদের ‘সেন্সর’ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছর বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে এর বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু আইনটিও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইনটি প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেছিলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেটা পাস হয়েছে, আমাদের মতে, শুধু খোলস পরিবর্তন ছাড়া সাইবার সিকিউরিটি আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এই বিষয়গুলো খর্ব করার মতো অনেক উপাদান এই আইনে রয়ে গেছে।’
অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এই আইন বাতিলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে ইতিমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর প্রথম কয়েক দিন আওয়ামী লীগ আমলে সরকারের সুবিধাভোগী ও সরকারের ‘প্রপাগান্ডা’ প্রচার করত বলে জনমনে ধারণা (পারসেপশন) থাকা কিছু টিভি চ্যানেল, প্রিন্ট সংবাদমাধ্যম হামলার শিকার হয়। তবে কিছুদিন পর গণমাধ্যমগুলোর কার্যালয়ে হামলার ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা দেওয়া হয়। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-সহ বিদেশি ও দেশি সংগঠন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা দেওয়ার বিষয়টির নিন্দা জানিয়ে আসছে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাদের সমালোচনা করুন। সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সে জন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।’
১৭ সেপ্টেম্বর ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সম্পাদক পরিষদ ৫ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বলে, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে আছে। বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ গণমাধ্যমসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ‘মব জাস্টিস’ কঠোর হাতে দমনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
২০ নভেম্বর ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা হত্যা মামলা নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে ভিত্তিহীন হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলায় ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের নাম আসার বিষয়টি পুরোনো আইন ও চর্চার ফল বলে মন্তব্য করেন। তড়িঘড়ি করে মামলা করতে গিয়ে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এ ধরনের মামলা করা বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে আশ্বস্ত করেন ড. ইউনূস। পাশাপাশি যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তি আছে কি না, তা একটি কমিটি পরীক্ষা করে দেখবে বলে জানান তিনি।
২১ নভেম্বর আরএসএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেওয়া বক্তব্যকে স্বাগত জানানো হয়। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কাঠামোগত সংস্কারের পথে এগিয়ে যেতে তাঁর প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
২৫ নভেম্বর সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চরম আক্রমণের মুখে বলে মন্তব্য করেছে।
নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এরই মধ্যে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন ধরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেছেন কিছু ব্যক্তি।
এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে নোয়াব গণমাধ্যমসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ‘মব জাস্টিস’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার) কঠোর হাতে দমন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ২৬ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক গণমাধ্যম এখনো ভুল সংবাদ ও গুজব প্রচার করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওপরে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তবে কোনো গণমাধ্যম অফিসে ভাঙচুর হলে সেটা সরকার দেখবে। জনগণ যেভাবে প্রত্যাশা করে, সেভাবে গণমাধ্যমের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না।