কয়লাখনি এলাকার লোকদের দিবারাত্রী কাটছে চরম আতঙ্কে!
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 10-05-2023
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকায় ফাঁটল যেন থামছেই না। প্রত্যেক বাড়ী ঘরের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় অনেক ফাঁটল।প্রত্যেক রাত কাটছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অর্থও নেই যে এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে নতুন করে আবারো বাড়ি গড়বে। তাই এভাবেই তাদের দিবারাত্রী কাটছে চরম আতঙ্কে।

 

মঙ্গলবার ৯ (মে) সরেজমিনে খনি এলাকা ঘুরে দেখা যায়,বাড়ি ভেঙে নিঃস্ব হয়ে খোলাস্থানে বসবাস করছেন পাতরাপাড়া শিবকৃষ্ণপুর গ্রামের আঁখি আক্তার। তিনি দিনমজুর সামেদুল ইসলামের স্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার (৪ মে) সামান্য বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে পূর্বে ফাটল ধরা তার মাটির বাড়িটি। এখন খোলা স্থানেই স্বামী, শ্বশুর,শাশুড়িসহ ছেলে মেয়ে নিয়ে দিনযাপন করছেন এই গৃহবধূ।

 

এমনই দৃশ্য যেনো এখন পুরো খনিএলাকাজুড়ে। কয়লাখনির ভূগর্ভের জমাটকৃত কয়লা ভাঙ্গার জন্য ডিনামাইট ফাঁটানোর (ব্লাস্ট) কারণে এ ফাটল দেখা দিয়েছে। নড়বড়ে হয়ে পড়েছে আঁধাপাকা-কাঁচা ঘরবাড়ী। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন গ্রামবাসী। রাতে ঘরবাড়ী ভেঙ্গে পড়ে পরিবারের কেউ যেন হতাহত না হয়, সেজন্য পালাক্রমে রাত জেগে থাকছেন পরিবারের একজন করে।

 

গ্রামবাসীর অভিযোগ, ভূগর্ভে ডিনামাইট বিস্ফোরণের কারণে ঘরবাড়ীতে ব্যাপকভাবে ফাঁটলসহ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে এমন বিষয়টি জানিয়ে খনি কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন নিবেদন করেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন’নি।

 

মঙ্গলবার (৯ মে) খনি গেট সংলগ্ন গোপালপাড়া মৌপুকুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামটি রয়েছে খনির মূল অংশ থেকে প্রায় ৩০০ গজের মধ্যে। সেখানে রয়েছে প্রায় ২০ টি বাড়ি। ভুগর্ভের কয়লা ফাটানোর জন্য ভূগর্ভে ডিনামাইট বিষ্ফোরণের জন্য ভূপৃষ্ঠে কম্পনের প্রভাবে গ্রামের দু-একটি পরিবার বাদে প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কমবেশি পাকা-আধাপাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ী ছোটবড় ব্যাপক আকারে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে সেরাজুল ইসলামের বাড়িটি। ধসে পড়ছে পিলারসহ আস্ত একটি কক্ষ। শুধু তারই নয় ভেঙেছে ওই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম আলী,তোফাজ্জল হক, তোজাম্মেল হক, শফিকুল ইসলাম, ওহিদুল ইসলাম, এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম, সাদেকুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, সামসুল রহমান, তসলিম উদ্দিন,ছোট এনামুল হক,সায়মাল হোসেন, মজমুল ইসলাম সহ প্রায় আরো অনেকের বাড়ি।

 

এলাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা সেরাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সোহানা আক্তার বলেন, ভূগর্ভের জমাটকৃত কয়লা চূর্ণবিচূর্ণ করতে ডিনামইটের বিষ্ফোরণ কম্পন ও বাংলাদেশ-ভারত পাইপলাইন স্থাপনের সময় পানিও ও কয়লা উত্তোলনের কারণে আমাদের শয়নকক্ষ ভেঙে পড়েছে। বড় ধরণের ফাটল দেখা দিয়েছে অন্য কক্ষগুলোতেও। পুরোটি ভেঙে পড়ে আমাদের মৃত্যুও ঘটতে পারতো। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন আমাদেরকে। এলাকার মধ্যে সবচেয়ে আমাদের বাড়িটি বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।

 

খনি সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলন এর পরের বছর ২০০৬ সালে খনি সংলগ্ন পাতরাপাড়া, কালুপাড়া, মৌপুকুর, বৈদ্যনাথপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি দেবে যেতে শুরু করে। এ নিয়ে গ্রামবাসী বিভিন্ন ব্যানারে পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরণের দাবি আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে খনি কর্তৃপক্ষ ৬৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণকৃত মৌপুকুর গ্রামটি দেবে গিয়ে বর্তমানে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ওই সময় গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে এক কিলোমিটার পশ্চিমে গোপালপাড়া মৌপুকুর নাম দিয়ে নতুন করে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানেও নতুন করে ফাঁটল দেখা দেওয়ায় গ্রামবাসী আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

 

মৌপুকুর গ্রামের বাসিন্দা সায়মাল হোসেন ও মজমুল ইসলাম বলেন, খনির কারণে ঘরবাড়ীতে ফাঁটল দেখা দেওয়াসহ মাটি দেবে যাওয়ার জন্য পূর্বের বাপ-দাদার ভিটেমাটি মৌপুকুর গ্রামের ছেড়ে ২০১০ সালে গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে ২০টি পরিবার নিয়ে গ্রাম গড়ে তোলা হয়। গত দু’বছর সেখানেও ঘরবাড়িতে বড় ফাটল দেখা দিচ্ছে।

 

মৌপুকুর গ্রামের কলেজ শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, ঘরবাড়ীতে ফাঁটল দেখা দেওয়ায় খনি কর্তৃপক্ষের কাছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিকার চেয়ে গ্রামবাসীর পক্ষে একটি আবেদন করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় পুনরায় ৯ এপ্রিল খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর পৃথক একটি আবেদন করা হয়। এ সময় মহাব্যবস্থাপক-জিএম (প্ল্যানিং এন্ড এক্সপ্লোরেশন ও সারফেস অপারেশন) আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়।

 

মহাব্যবস্থাপক-জিএম (প্ল্যানিং এন্ড এক্সপ্লোরেশন ও সারফেস অপারেশন) আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান চৌধুরী বলেন, খনির চীনা ঠিকাদারিপ্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম এসব বিষয়গুলো দেখভাল করবে। চুক্তিতেও তাই বলা রয়েছে। ঠিকাদারের প্রতিবেদনের ওপর বিসিএমসিএল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়াম এ গত সপ্তাহ আগে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, মহাব্যবস্থাপক-জিএম (প্ল্যানিং এন্ড এক্সপ্লোরেশন ও সারফেস অপারেশনের দায়িত্বে থাকা আবু তাহের মো. নূর-উজ-জামান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললে বিস্তারিত জানা যাবে।

 

শেয়ার করুন