অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে চার মাসে একের পর এক বিষয় নিয়ে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। পদোন্নতি, পদায়নসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের। নিয়মিত (রুটিন) কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে পারছে না প্রশাসন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদায়ন, পদমর্যাদা ও আর্থিক সুবিধার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নাগরিক সেবা সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার প্রশাসনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বর্তমানে প্রশাসন থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নাগরিক সেবা সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের গতি বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি।
সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন কয়েক শ কর্মকর্তা। আবার অন্য ২৫টি ক্যাডারের জোট আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদও কমিশনের সুপারিশে ক্ষোভ জানিয়েছে। তারাও আন্দোলনে নামছে। আজ সোমবার কেন্দ্রীয়ভাবে বিবৃতি, এরপর কলমবিরতি, মানববন্ধন ও সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ফলে জনপ্রশাসনে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক কার্যক্রমে যদি কিছুটা ধীরগতি হয়, সেটা সাময়িক। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। তিনি মনে করেন, যেকোনো সরকারের সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছে নাগরিক সেবার মান বাড়ানো। বর্তমান সরকার নিশ্চয়ই সেদিকে নজর দিচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় ৮ আগস্ট। এ সরকারের সাড়ে চার মাসেও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাড়ে চার মাসে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সচিব করা হয়েছে ২৩ কর্মকর্তাকে। গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৭ জন। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৪ জন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক কার্যক্রমে যদি কিছুটা ধীরগতি হয়, সেটা সাময়িক। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
১৪টি মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে। বিগত সরকারের সময়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হলেও অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে।
আবার কোনো কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করার পর চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। সাড়ে চার মাসে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বদলির আদেশ পরে প্রত্যাহার করতে হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। গত সাড়ে চার মাসে সাবেক সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রশাসনে এবারই প্রথম এত সংখ্যক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেন। এবারই সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সচিবদের নামে। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকারসহ এখনো চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সচিব পদ খালি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিব পদে যোগ দেওয়া অন্তত ২৭ জন কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন। অন্য সচিবদের মধ্যে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাউকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। কেউ স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। তবে যাঁরা এখনো সচিব পদে বহাল আছেন, তাঁরা থাকবেন কি না, সেটি নিশ্চিত নন। তাই বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কেমন প্রশাসন চায়, সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। বিগত সরকারের সময়ে সচিব হওয়া কর্মকর্তাদের রাখা হবে, নাকি সরিয়ে দেওয়া হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। এ কারণে পুরো প্রশাসনে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
প্রশাসনে কাজের গতি খুবই মন্থর। মানুষ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কর্মকর্তাদের উচিত, আদাজল খেয়ে কাজে নেমে পড়া। প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের দুর্নাম গোছানোর এখনই সময়।
এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিব
পদোন্নতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তারা যেমন পদোন্নতি পেয়েছেন; আবার দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। ঢালাও পদোন্নতিতে অনেক অদক্ষ কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়ে যান। এ নিয়ে প্রশাসনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দেয়, বিগত সরকারের সময়ের চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করা হবে। সে অনুযায়ী শতাধিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। তবে একই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে তাঁদের অনেকের প্রশাসনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জন সাবেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি। সচিব পদে ১১৯ জনকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে।
দুজন অতিরিক্ত সচিব প্রথম আলোকে বলেন, অবসরে যাওয়ার এক দশক পর আবার সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ায় দুটি সমস্যা হচ্ছে। এক. দীর্ঘদিন তাঁরা প্রশাসনের কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। এই দীর্ঘ সময়ে প্রশাসনের কাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এগুলোর সঙ্গে তাঁদের কোনো যুক্ততা নেই। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কোনোরকম যোগাযোগ নেই। ফলে তাঁদের পক্ষে প্রশাসনকে গতিশীল করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই. জনপ্রশাসনে এখন যাঁরা সচিব হওয়ার অপেক্ষায় আছেন, তাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে তাঁদের মধ্যে হতাশা তৈরি হতে পারে।
প্রশাসনে এখন যে অবস্থা চলছে, এটিকে বিশৃঙ্খলা বলা ঠিক হবে না। ১৭ বছরের একটা বঞ্চনা, অনিয়ম প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রশাসন গেছে। দীর্ঘদিন পর অনেক কর্মকর্তা কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। সে জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা এমনটি করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. বাবুল মিঞা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান করা হয় ১০ ডিসেম্বর। ১২ দিন পর গতকাল নতুন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান নাসিমুল গনি।
স্থানীয় সরকারসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয় গত ৬ অক্টোবর। দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখানে নতুন সচিব দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম সচিবের নিয়মিত (রুটিন) কাজ করে যাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) মতো সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব শাহানারা খাতুনকে ওএসডি করা হয় ১০ নভেম্বর। এ বিভাগে নতুন কাউকে সচিব দেওয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগের সচিব পদও খালি রয়েছে। ফলে এসব মন্ত্রণালয়ে কাজ স্থবির হয়ে আছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. বাবুল মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনে এখন যে অবস্থা চলছে, এটিকে বিশৃঙ্খলা বলা ঠিক হবে না। ১৭ বছরের একটা বঞ্চনা, অনিয়ম প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রশাসন গেছে। দীর্ঘদিন পর অনেক কর্মকর্তা কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। সে জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা এমনটি করছেন। পদোন্নতি, পদায়নে যতটা আগ্রহ, জনসেবায় ততটা দেখা যায় না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৭ বছরে প্রশাসনে যে অবক্ষয় হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জনসেবাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নিশ্চয়ই বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার আরেকটি উদাহরণ হলো, কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করে আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। তদবির করে কেউ কেউ বদলির আদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। আবার সমন্বয়হীনতার কারণে বদলির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে সরকারকে। এতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে।
যেমন গত ১৮ নভেম্বর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) গাজী মো. সাইফুজ্জামানকে ওএসডি করা হয়। পরে সেই আদেশ প্রত্যাহার করতে হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে।
আদাজল খেয়ে কাজে নেমে পড়া। এটা করলে কর্মকর্তাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান বাড়বে। প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের দুর্নাম গোছানোর এখনই সময়।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার
ঠাকুরগাঁওয়ে একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইসরাত জাহানকে রাঙামাটিতে বদলি করা হয় চলতি মাসের শুরুতে। সেখানে ডিসি দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাবিব উল্লাহকে। পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। হাবিব উল্লাহকে রাঙামাটিতে পাঠানো হয়। ইসরাত জাহানকে ঠাকুরগাঁওয়ে রাখা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মাজেদুর রহমান খানকে বদলি করা হলেও সেটি পরে প্রত্যাহার করা হয়। এ রকম অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার বদলির আদেশ পরে প্রত্যাহার করতে হয়েছে।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনে কাজের গতি খুবই মন্থর। মানুষ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক চাপ নেই। কর্মকর্তাদের উচিত, আদাজল খেয়ে কাজে নেমে পড়া। এটা করলে কর্মকর্তাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান বাড়বে। প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের দুর্নাম গোছানোর এখনই সময়।