বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে নিহত তিনজনের পরিবার আজ আদালতে তিনটি হত্যা মামলা করেছে। এগুলোর একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদকেও আসামি করা হয়েছে।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আহম্মেদ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলা তিনটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
নিহত তিনজন হচ্ছেন যাত্রাবাড়ী এলাকার ফলবিক্রেতা ফরিদ শেখ, কলেজশিক্ষার্থী ইমাম হাসান ও স্কুলছাত্র সিয়াম।
ফলের দোকানদার ফরিদ শেখকে হত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছেন তাঁর বাবা সুলতান শেখ। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর আসামিরা হলেন, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান।
মামলায় বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ৩টার দিকে যাত্রাবাড়ীর হানিফ উড়াল সড়কের টোল প্লাজার সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন ফরিদ শেখ। তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে গুরুতর জখম হন ফরিদ। পরে তাঁকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ অন্যরা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেন।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী এম ডব্লিউ কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ইমাম হাসানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ পরিদর্শক জাকির হোসেনসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সিয়ামের মা পারভীন আক্তার। মামলার অপর চার আসামি হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন, অতিরিক্ত উপকমিশনার শাকিল মোহাম্মদ, সহকারী পুলিশ কমিশনার তানজিল আহমেদ ও শাহবাগ থানায় কর্মরত এসআই শাহাদাত আলী।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ভিডিও ফুটেজে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও অনেক আসামি রয়েছেন। মামলায় ইমাম হাসানের মা দাবি করেছেন, তাঁর স্বামী ময়নাল হোসেন পুলিশের উপপরিদর্শক। তিনি পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত আছেন। কোটা সংস্কারের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে তাঁদের ছেলে অংশ নিয়েছিলেন। ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে তাঁদের ছেলে কাজলা উড়ালসেতুর নিচে চা খেতে গিয়েছিলেন। তখন পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করছিল। তখন ইমাম হাসান একটি চায়ের দোকানে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা জাকির হোসেন ইমাম হাসানসহ কয়েকজনকে দোকান থেকে বের করে আনেন। বাঁচতে চাইলে দৌড় দিতে বলেন পুলিশ কর্মকর্তা জাকির হোসেন। এরপর দৌড় দিলে জাকির হোসেন পেছন থেকে তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেন। তখন রাহাত হোসেন নামের এক তরুণ তাঁর ছেলেকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা আবারও গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমাম হাসান মারা গেছেন। আসামিরা পরিকল্পিতভাবে তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন পারভীন আক্তার।
ভোলার চরফ্যাশনের ওসমানগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়ামকে হত্যার অভিযোগে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সিয়ামের বাবা মো. জিয়া। মামলায় সাবেক আইজিপি ছাড়া ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. ইকবাল হোসেন, সহকারী কমিশনার মিঠুন কুমার কুন্ডু, গেন্ডারিয়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মোস্তফা কামাল, নারায়ণগঞ্জের রায়হান, শাহাবুদ্দিন, সাজেদ খান, জাকির হাওলাদার, আবদুর রাজ্জাক, সজল ও জিয়াউল হককে আসামি করা হয়েছে। মামলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ পুলিশের ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বাদীর আইনজীবী শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিয়ামের বাবা একজন দিনমজুর। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। সিয়াম ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছিল। ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারা মিছিল করতে করতে হানিফ উড়ালসড়কের গোলচত্বরের কাছে এসেছিল। তখন পুলিশ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে সিয়াম গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।