সতর্কসংকেত ও লাল নিশানা, কিছুই মানছেন না পর্যটকেরা
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 15-09-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

সাগর উত্তাল থাকায় বহাল রয়েছে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের গোসল করতে নামার নিষেধাজ্ঞা হিসেবে বালুচরে ওড়ানো হয়েছে একাধিক লাল নিশানা। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে সাগরের পানিতে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছেন অনেক পর্যটক। আজ রোববার দিনভর এমনই চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে।

সাগরে গোসল করতে নামা পর্যটকদের উদ্ধারে কাজ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সি-সেফ লাইফগার্ড। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে আজ সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্টের পাঁচ কিলোমিটার সৈকত এলাকা ভ্রমণে আসেন প্রায় ২৪ হাজার পর্যটক। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার সমুদ্রে নেমে গোসল করেছেন।

লাইফগার্ডের সদস্যরা জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাঁরা পানিতে নামেন, তাঁদের হাঁটু থেকে সর্বোচ্চ কোমরসমান পানি পর্যন্ত যেতে বলা হয়। এরপরও অনেকে গভীর সাগরে ঢেউয়ের সঙ্গে খেলতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। এ ধরনের বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করতে হয়েছে।

বেলা ১১টার দিকে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ পর্যটক বালুচরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছেন। তবে প্রায় চার হাজার পর্যটক কোমরপানিতে গোসল করতে ব্যস্ত। বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে দাপাদাপি করতে দেখা যায় তাঁদের। এর মধ্যেই লাইফগার্ড ও বিচ কর্মীরা বাঁশি বাজিয়ে তাঁদের সতর্ক করছেন। হাতমাইকে সতর্ক করা হচ্ছে পর্যটকদের। তবে সেদিকে কারও নজর নেই।

সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, সুগন্ধা পয়েন্টেই কেবল একসঙ্গে এসেছেন অন্তত ১০ হাজার পর্যটক। এর মধ্যে অনেকেই গোসল করতে নামেন। এত বিপুল পর্যটকের নিরাপত্তা দিতে লাইফগার্ডের ২৭ কর্মীকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে।

সুগন্ধা সৈকতে কথা হয় ঢাকার কমলাপুর থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী আজমল হকের সঙ্গে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসেন গত বৃহস্পতিবার বিকেলে। ভারী বর্ষণের কারণে হোটেল-মোটেল জোন ডুবে যাওয়ায় শুক্রবার বিকেল চারটা পর্যন্ত হোটেলের কক্ষেই থাকতে হয়েছে তাঁদের।

আজমল হক (৫০) বলেন, সমুদ্রের আকর্ষণে তাঁরা বারবার কক্সবাজার ছুটে আসেন। কিন্তু বৈরী পরিবেশে সাগর উত্তাল হলে লাল নিশানা ওড়ানো হয় এবং পানিতে নামতে পর্যটকদের নিষেধ করা হয়। অথচ কয়েক লাখ টাকা খরচ করে কয়েক শ মিটার এলাকা জাল দিয়ে ঘিরে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করা যেত।

ঢাকার মগবাজারের কামরুল ইসলাম (৪৫) বলেন, অনেক টাকা খরচ করে পর্যটকেরা কক্সবাজার ছুটে আসেন সমুদ্রের টানে। ঝড়-তুফান যা–ই হোক, পর্যটকেরা লোনাপানিতে শরীর ভেজাবেনই। এটুকু মাথায় রেখে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কক্সবাজারে সাগরে গোসল করতে নেমে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন পর্যটকেরা। ৪ সেপ্টেম্বর সুগন্ধা পয়েন্টের গুপ্তখালে আটকা পড়ে নিখোঁজ হন ঢাকার পল্লবী এলাকার কাজী জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে সজীব হোসেন (২৬)। এক দিন পর তাঁর মরদেহ ভেসে ওঠে তিন কিলোমিটার দূরের নাজিরারটেক সৈকতে।

সি-সেফ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় গত কয়েক দিনে গভীর সাগর থেকে ছয় পর্যটককে উদ্ধার করেছেন লাইফগার্ডের কর্মীরা। গত আগস্টে গোসল করতে নেমে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। গত ছয় বছরে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন ৪৭ পর্যটক। ছয় বছরে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত ৭০০ পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে।

সি-সেফ লাইফগার্ডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে কয়েক দিন ধরে সাগর প্রচণ্ড উত্তাল রয়েছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সৈকতের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। পানিতেও একাধিক গুপ্তখাল ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গোসলে নেমে কেউ গর্তে আটকা পড়লে উদ্ধারের জন্য সৈকতে ডুবুরি নেই। কেবল স্রোতের টানে ভেসে গেলে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পারেন লাইফগার্ডের কর্মীরা।

হোটেলমালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সাম্প্রতিক ভারী বৃষ্টি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙন ধরেছে। তাতে হাঁটাচলার বালিয়াড়ি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ভাঙন সংস্কারের উদ্যোগ নেই।

 

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করেও কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের জন্য ‘সুইমিং জোন’ গড়ে তোলা যায়নি। কয়েক বছর আগে লাবণী পয়েন্টে একটি সুইমিং জোন করা হলেও সেটিরও বিলুপ্তি ঘটেছে। আড়াই বছর আগে লাবণী পয়েন্টের ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই কিলোমিটার বালুভর্তি জিও টিউবের বাঁধ দিয়েছিল। এর পর থেকে লাবণী সৈকত মানুষের মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, সমুদ্রে গোসলে নেমে কেউ মারা গেলে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নেই। পর্যটকদের নিয়ে কমবেশি সবাই ব্যবসা করলেও নিরাপদ গোসলের উদ্যোগ নেই।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, লাইফগার্ডের পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসনের নিয়োগ করা ৩৮ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিচ কর্মী রয়েছেন। ঝুঁকি নিয়ে গোসলে না নামার জন্য তাঁরাও প্রচারণা চালাচ্ছেন। ডুবুরি নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।


 

শেয়ার করুন