কেমন ছিল রিমালের আগের যত ঘূর্ণিঝড়
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 26-05-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত ও এতে প্রাণহানি–ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে এ দেশের মানুষ, বিশেষ করে উপকূলবাসীর পরিচয় নতুন নয়। এই মহাশক্তির পরাক্রম অনেক প্রাণ কেড়েছে, তছনছ করেছে বহু বাড়িঘর, সাজানো সংসার। ডুবিয়েছে মাঠের ফসল, ভাসিয়ে নিয়েছে পুকুরের মাছ। যত্নে লালন করা পশুপাখিও রেহাই পায়নি। তারপরও থামেনি জীবনের স্পন্দন।

অদম্য বাঙালি জলোচ্ছ্বাসের পর জেগে ওঠা নতুন মাটিতে তুলেছে নতুন ঘরের চালা। শোকতাপ বুকচাপা দিয়ে লাঙল চালিয়েছে ফসলের মাঠে। ভেঙে যাওয়া বাঁধজুড়ে দিয়েছে সম্মিলিত চেষ্টায়। ধেয়ে আসতে থাকা রিমালকেও মোকাবিলা করে টিকে যাবে বীর বাঙালি—এই আশা ও প্রার্থনা থাকবে আজ দেশের প্রত্যেক মানুষের।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুপুর ১২টায় আবহাওয়া বিভাগের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে, পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ও বাগেরহাটের মোংলার ২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।

 

আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় যে বেগে এগিয়ে আসছে, তাতে আজ সন্ধ্যানাগাদ মোংলা সমুদ্রবন্দর ঘেঁষে খেপুপাড়া উপকূল পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে চলে যেতে পারে এটি। সমুদ্র বিক্ষুব্ধ রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বয়ে যাচ্ছে দমকা বাতাস। শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

রাজধানীতেও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরেছে কোথাও কোথাও। আছে হালকা বাতাস। তাতে গায়ে জ্বালা ধরানো গরমে তীব্রতা কমায় স্বস্তি বোধ হচ্ছে জনজীবনে। কিন্তু উপকূলে রিমাল শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালীতে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া বিভাগ। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে, তা ছাড়া খুলনা অঞ্চলের নদীবন্দরগুলোয় থাকবে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপৎসংকেত।

আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

রিমালের নাম দিয়েছে ওমান। আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান জানালেন, ‘রিমাল’ আরবি শব্দ। ওমানে বালিঝড়কে বলা হয় ‘রিমাল’। সেখান থেকেই এ নামকরণ। ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরোনো। সাধারণত বড় ঘূর্ণিঝড়গুলো আলাদা করে চেনা ও এগুলো সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণের সুবিধার জন্য প্রতিটির আগাম নামকরণ করা হয়।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, পটুয়াখালী, ২৬ মে

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, পটুয়াখালী, ২৬ মেছবি: সাইয়ান

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) নামকরণের বিষয়টি তদারক করে থাকে। উত্তর আটলান্টিক ও উত্তর–পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে নামকরণ শুরু হয় সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। তিন বছর পর ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামের আগাম তালিকা করার রেওয়াজ চালু হয়। ডব্লিউএমও  ২০০২ সাল থেকে তাদের আঞ্চলিক অফিসগুলোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে আলোচনা করে সেসব দেশের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আমাদের অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রথম নামকরণ করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি নাম ছিল ‘অনিল’।

 

এ দেশে সবচেয়ে ভয়ানক যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেটি ‘সিডর’। এ নামটিও ওমানের দেওয়া। সেখানে একধরনের বৃক্ষের নাম সিডর। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলে আঘাত হেনেছিল এই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে আরেকটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। নামটি মালয়েশিয়ার দেওয়া। আইলায় বাতাসের বেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। সিডর-আইলা ছাড়াও বেশ কয়টি বড় ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ‘মহাসেন’ আঘাত হানে ২০১৩ সালের ১৬ মে, ‘কোমেন’ ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই, ‘রোয়ানু’ ২০১৬ সালের ২১ মে, ‘মোরা’ ২০১৭ সালের ৩১ মে, ‘আম্পান’ ২০২০ সালের ১৩ মে।

ঘূর্ণিঝড় রিমাল এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ চালুর আগে যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়গুলো এ দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে, সেগুলোর মধ্যে বাতাসের বেগ সবচেয়ে বেশি ছিল ১৯৯৭ সালের ১৯ মে সীতাকুণ্ডে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের। আবহাওয়া বিভাগের রেকর্ড অনুসারে এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ২৩২ কিলোমিটার। চট্টগ্রামে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তার বেগ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ২২৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রামেই ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের বেগ ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ, ২২৪ কিলোমিটার।

 

এ ছাড়া ১৯৯৪ সালের ২ মার্চ কক্সবাজার-টেকনাফে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের বেগ ছিল ২২০ কিলোমিটার। পরের বছর ১৯৯৫ সালের ১২ মে কক্সবাজারেই ২১০ কিলোমিটার ও ১৯৬৩ সালে এ জেলায় ২০৯ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়।

ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক ঘটনা। একে প্রতিরোধ করা অসাধ্য। কিন্তু মানুষ তার অনন্য অদম্য প্রাণশক্তি দিয়ে সব দুর্যোগ-প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জীবনের বনিয়াদ অব্যাহত রেখে যায়। আমাদের দেশের মানুষও সেই প্রমাণ রেখেছেন। সেই যে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়ঃ/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ যত ঝড়ঝাঁপটা আসুক, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই বীর বাঙালি।

শেয়ার করুন