ছয় ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা শুরু, নির্ধারিত হবে এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 09-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সংকটে পড়া ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের (ঋণের) প্রকৃত আর্থিক চিত্র বের করতে নিরীক্ষা শুরু করেছে দুই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং এবং কেপিএমজি। এসব ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ, অবসায়ন করা হবে নাকি মূলধন জুগিয়ে ও ঋণ আদায় জোরদার করে শক্তিশালী করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। ফলে নিরীক্ষা শেষে নির্ধারিত হবে এসব ব্যাংকের ভবিষ্যত।

আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই বিশেষ নিরীক্ষা শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বহুপক্ষীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ কাজের জন্য অর্থ দিচ্ছে।

ব্যাংক ছয়টি হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ইতিমধ্যে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

 

এই নিরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিটি ব্যাংকের জন্য একজন কর্মকর্তাকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও একজন কর্মকর্তা বিশেষ দায়িত্বে থাকবেন। কী কী তথ্যের ভিত্তিতে নিরীক্ষা করা হবে, ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোকে তা জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় নিরীক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংক ছয়টিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। আগামী সপ্তাহের শুরুতে দুই নিরীক্ষা সংস্থার একাধিক প্রতিনিধি দেশে আসার কথা রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং নিরীক্ষা করছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত মান। কেপিএমজির নিরীক্ষার আওতায় রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের সম্পদ। এর মধ্যে চারটি ব্যাংকের মালিকানা ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলমের হাতে। তাঁর মালিকানাধীন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি এসব ব্যাংকের বড় অঙ্কের অর্থ নামে-বেনামে বের করে নেয়, যা এখন ফেরত আসছে না। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

কেন এই নিরীক্ষা

ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে নানা তথ্য চেয়েছে, যা নিরীক্ষকদের সরবরাহ করা হবে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার লক্ষ্য হলো ঋণদানে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি, গুরুত্বপূর্ণ সেবাদান নিশ্চিত, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করা। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করতে চায়। ব্যাংকিং খাতের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে এবং বিভিন্ন পক্ষ জড়িত থাকে। এর মধ্যে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এই বিবেচনায় আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত মানের সঠিক মূল্যায়ন করতে নিয়োগ করা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকগুলোর সম্পদ গুণগত মান পর্যালোচনা (একিউআর) করতে নিয়োগ করেছে। এই পর্যালোচনার আওতায় আসবে ব্যাংকগুলোর গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সম্পদ। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিনিয়র ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তা, নিরীক্ষক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথিপত্র সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ করবে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর যে ক্ষতি করা হয়েছে, তা স্থানীয় ভালো নিরীক্ষক দিয়ে বের করা হলে তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলত। এ জন্য আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ। এতে অনিয়মের প্রকৃত সুবিধাভোগী ও কারা দায়ী তা বের হবে। তাদের প্রতিবেদন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না, যা দিয়ে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে আইনি কাজে ব্যবহার করা যাবে। এতে অনেকের মুখও বন্ধ করা যাবে।’

যেসব তথ্য খোঁজা হচ্ছে

চিঠিতে একিউআর প্রক্রিয়ায় কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো আর্থিক নীতিমালা, সম্পদের ঝুঁকি ও মূল্যায়ন; অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা, ঋণ শ্রেণীকরণ ও পুনঃতফসিল ঋণ। এ ছাড়া একক ঋণগ্রহীতা ও বড় ঋণের সীমা–সম্পর্কিত নীতিমালা, ব্যাংকের বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা এবং অন্যান্য ঋণঝুঁকি কমাতে ব্যাংকের হিসাবরক্ষণ নীতিমালা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণপদ্ধতির মূল্যায়ন করা হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান নিয়মাবলি অনুযায়ী তারল্য ও বিনিয়োগ নীতিমালার মূল্যায়ন করা হবে।

ঋণপত্রসহ ব্যাংকের অন্য ঋণ অনুমোদন ও ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামোর আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যতাসহ ঋণের গুণগত মূল্যায়ন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণের এবং আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম অনুশীলন করে লোকসানের প্রকৃত চিত্র; ব্যাংকের বৈদেশিক দায় নির্ধারণ করা এবং তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি মেনে হয়েছে কি না; ব্যাংকের পৃথক ঋণ এবং সিকিউরিটিজ পর্যালোচনা; ঋণ ছাড়া অন্যান্য সম্পদ যার ঋণঝুঁকি আছে—এসব বিষয়ও পর্যালোচনা করা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ঋণের বিপরীতে যে জামানত আছে, তা মূল্যায়ন করবেন নিরীক্ষকেরা। এর পাশাপাশি জব্দ সম্পত্তির দামও পর্যালোচনা করা হবে। বড় খেলাপি ও ইচ্ছাকৃত ঋণগ্রহীতাদের চিহ্নিত করা এবং এ–সংক্রান্ত পদ্ধতির মূল্যায়ন করা হবে। বড় ঋণের সীমার উদ্দেশ্যে, একক ঋণগ্রহীতা গ্রুপ এবং গ্রুপ–সম্পর্কিত পক্ষকে চিহ্নিত করার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হবে। একই সঙ্গে ঋণের সঙ্গে সাবেক ও বর্তমান পরিচালক এবং অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সম্পর্ক আছে কি না, তা চিহ্নিত করা হবে। ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণ পর্যালোচনা এবং চিহ্নিত করা হবে এ নিরীক্ষার আওতায়। নিরীক্ষার আওতায় আনা ব্যাংকের সম্পদের গঠন বিশ্লেষণ করা হবে।

ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, নথিপত্র তৈরি করে তা ছেপে ও ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। পাশাপাশি এই নথিপত্রগুলোর একটি কপি সংরক্ষণ করতে হবে, যা পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যাবে। নিযুক্ত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে সম্পদের গুণগত মান পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে পূর্ণ সহযোগিতা করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেয়ার করুন