নিরীক্ষা আইনের খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে ১৬ বছর
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 12-05-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

দেশে কোনো নিরীক্ষা আইন নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রথমবারের মতো এ আইন করার উদ্যোগ নেয় ১৬ বছর আগে ২০০৮ সালে। চার বছর পর ২০১২ সালে একটি খসড়াও তৈরি করা হয়। তারপরও কেটে গেছে এক যুগ। শেষ দুই বছর ধরে আইনের খসড়া শুধু ঘষামাজা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।

খসড়া আইনটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘পাবলিক অডিট বিল’। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল তিন সপ্তাহের সময় দিয়ে এ আইনের খসড়ার ওপর উন্মুক্ত মতামত চেয়েছিল অর্থ বিভাগের প্রশাসন ও সমন্বয় অনুবিভাগ। কিছু মতামতও পায় তারা। মতামত বিশ্লেষণের জন্য অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফাকে প্রধান করে গত বছর একটি কমিটিও করে দিয়েছিল অর্থ বিভাগ। সেই কমিটি সময়মতোই প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে বিষয়টি থমকে আছে একই জায়গায়।

আইনের খসড়া পড়ে আছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দেওয়া হয়েছে। আইনের খসড়া পড়ে থাকার বিষয়টি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

 

বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং দেশব্যাপী তিন দিনের বিশেষ সেবা কার্যক্রম উপলক্ষে গতকাল শনিবার সংস্থাটির কার্যালয়ে যে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সিএজি মো. নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।

ওই অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী হিসাবব্যবস্থায় সংস্কার আনার পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, ‘এ সংস্কার আনতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও উন্নয়ন সহযোগীদের চাহিদা পূরণে। প্রচলিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা ও আর্থিক নিরীক্ষার পাশাপাশি পারফরম্যান্স নিরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) নিরীক্ষা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে হবে।’

 

সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে মানসম্পন্ন নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে সিএজির সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার এবং এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করবে বলেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।

সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের অবহেলার কথা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, ‘উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রায় ২৩৫টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু কোনো আলোচনা হয়নি।’

সিএজি মো. নুরুল ইসলাম ও অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার পেনশনের টাকা তোলায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। তবে উদ্যোগ নেওয়ার ১৬ বছর পরও একটি আইন কেন আলোর মুখে দেখল না, সে বিষয়ে কেউ কথা বলেননি।

মন্ত্রণালয়গুলো জবাব দিতে চায় না

সংবিধানের ১২৭ থেকে ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিএজির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংবিধানের ১২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মহা-হিসাব নিরীক্ষক প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব এবং সব আদালত, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব নিরীক্ষা করবেন ও অনুরূপ হিসাব সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করবেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি বা সেই প্রয়োজনে তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তির দখলভুক্ত সব নথি, বই, রসিদ, দলিল, নগদ অর্থ, স্ট্যাম্প, জামিন, ভান্ডার বা অন্য প্রকার সরকারি সম্পত্তি পরীক্ষার অধিকারী হবেন।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি হচ্ছে নিরীক্ষা। অথচ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের যেসব আপত্তি ওঠে নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলোয়, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে এগুলোর জবাব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। নিরীক্ষা আইন হলে এই প্রবণতা রোধ করা যেত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন সাবেক সচিব নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জবাব এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। জবাব দিতে গেলে নিজেদের ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

সিএজি কার্যালয়ের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী অনিয়মের আপত্তির জবাব দিতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়ের মধ্যে জবাব আসে না এবং জবাব ছাড়াই তৈরি হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদন। সিএজি কার্যালয়ের প্রস্তুত করা নিরীক্ষা প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরের পর সেগুলো যায় সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে। কমিটি অনেক সময় বৈঠকই ডাকে না।

 

টিআইবি ২০১৫ সালে কী বলেছিল

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৫ সালে ‘মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০ দফা সুপারিশ করেছিল।

স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি রোধকল্পে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, জনবলকাঠামো ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেওয়া; সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সব বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা; সিএজিসহ সব ধরনের নিয়োগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সমমর্যাদা দেওয়াসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা; নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন করার ও জমা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা; সিএজি কার্যালয়ের অভিযোগ সেল সম্পর্কে সরকারি কার্যালয়গুলোকে জানানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

মধ্যমেয়াদি সুপারিশ হিসেবে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আকারের দুর্নীতির তথ্যগুলো সিএজি যেন সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে (পিএসি) দেয়। এরপর অভিযোগ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সুপারিশ করবে পিএসি। এ ছাড়া ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ করা এবং মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা করার জন্য নিরীক্ষা দল গঠন করা, জরুরি কার্যক্রমের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পুরোনো নিরীক্ষা আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরকে আলাদা অধিদপ্তরে ভাগ করা ইত্যাদি।

এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যয় ও হিসাবের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়গুলোয় দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শাখা খোলা, নিয়মানুবর্তী নিরীক্ষা থেকে পারফরম্যান্স নিরীক্ষার দিকে যাওয়ার কৌশল তৈরি করা এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনটি নিয়ে সরকারের কার্যকলাপকে হতাশাজনকই বলব। সরকারের মধ্যে সিএজি কার্যালয়ের মতো একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার প্রবণতা রয়েছে। কিছু ভালো নিরীক্ষা প্রতিবেদনও ইদানীং হচ্ছে, কিন্তু দুঃখজনক যে এগুলো নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয় না।’


 

শেয়ার করুন