রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বাসার পাশে খেলছিল তিন বছরের মো. সিদ্দিক। তখন তাকেসহ খেলতে থাকা অন্য শিশুদের চকলেট খেতে দেন এক ব্যক্তি। এক পর্যায়ে কৌশলে শিশুটিকে কোলে নিয়ে পালিয়ে যান তিনি। এ ঘটনায় দায়ের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলার তদন্তে নেমে পাওয়া যায় সিসিটিভি ফুটেজ। তাতে শিশুটিকে অপহরণের দৃশ্য ধরা পড়ে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ২৩ দিন পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে র্যাব-২। এরই মধ্যে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভিন্ন নাম-পরিচয়ে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে শিশুটিকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন– অপহরণকারী পীযূষ কান্তি পাল, তাঁর স্ত্রী রিদ্ধিতা পাল, শিশুটিকে কিনে নেওয়া পল্লব কান্তি বিশ্বাস, তাঁর স্ত্রী বেবী সরকার ও কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী সুজন সুতার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ থেকে প্রথমে সুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার তাড়াসি গ্রাম এবং ঢাকার সাভার থেকে অপর চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন খান বলেন, গত ২৬ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা উদ্যানের সি-ব্লকের এক নম্বর সড়ক থেকে সিদ্দিককে অপহরণ করা হয়। তখন সেখানে অন্য শিশুদের সঙ্গে তার আট বছর বয়সী বোন হুমায়রাও ছিল। পীযূষ তাকে বলে– ‘তুমি বাসায় চলে যাও। তোমার ভাইকে আমি বাজার থেকে আম কিনে দেব।’ মেয়েটি যেতে না চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সিদ্দিককে নিয়ে চলে যায় পীযূষ। হুমায়রা ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে যায়। তার মা কাজ শেষে বাসায় ফিরে মেয়ের কাছে ঘটনাটি জানতে পারেন। তিনি তখনই তাঁর স্বামী দেলোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জানান। আশপাশে অনেক খুঁজেও সন্ধান না পেয়ে তাঁরা মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন। পরে ২৯ এপ্রিল এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়। জিডি হওয়ার পরই ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে জড়িতদের গ্রেপ্তারে তৎপর হয় র্যাব। এক পর্যায়ে অপহরণকারী হিসেবে শনাক্ত হন পীযূষ। পরে জানা যায়, তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী রিদ্ধিতা।
গ্রেপ্তার পীযূষ ও রিদ্ধিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব অধিনায়ক জানান, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার সময় স্পা সেন্টারে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন পীযূষ। সেখানে রিদ্ধিতা পালের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁরা ২০২০ সালে বিয়ে করেন। স্পা সেন্টারে কাজ করার সময় থেকেই পীযূষ মানব পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়েন। গত বছরের মে মাসে মানব পাচারের অভিযোগে বনানী থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় কিছুদিন কারাগারে থেকে জামিনে মুক্তি পান। তাঁরা ফেসবুকে ‘সনাতনী উদ্যোক্তা ফোরাম’ নামে গ্রুপ খুলে শিশু বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছিলেন। সুজন ওই গ্রুপে শিশু দত্তক নেওয়ার জন্য পোস্ট দিলে রিদ্ধিতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তাঁর গৃহকর্মী সন্তানকে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে দত্তক দিতে চান। এর পর ২১ এপ্রিল নিজের এক বছর বয়সী ছেলে প্রণিল পালের ছবি পাঠিয়ে বলেন, এই ছেলেকে দত্তক দেওয়া হবে, আপনাদের পছন্দ হয় কিনা জানান। সুজন রাজি হলে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে শিশু অপহরণের চেষ্টা শুরু করেন পীযূষ ও রিদ্ধিতা। পরে সিদ্দিককে অপহরণ করা হয়। পীযূষ তাকে নিয়ে সাভারের বাসায় যান। এর মধ্যে রিদ্ধিতা ফোন করে ওই দিন বিকেলেই সুজনকে আগারগাঁওয়ে আসতে বলেন। সেখানে তিনি নিজেকে অর্পণা দাস ও স্বামীকে বিজন বিহারী পাল পরিচয় দিয়ে স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তি করে শিশুটিকে বিক্রি করেন। এ সময় শিশুটির নাম প্রণিল পাল, তার মা গৃহকর্মী রিদ্ধিতা পাল ও বাবা বিজয় কুমার পাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রমাণ হিসেবে নিজের সন্তান প্রণিলের টিকাকার্ড, জন্মসনদ এবং বিজন বিহারী পালের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার সুজন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তাঁর নিঃসন্তান বড় বোন বেবী ও ভগ্নিপতি পল্লব একটি শিশু দত্তক নিতে চাইছিলেন। সে জন্যই তিনি শিশুটিকে কেনার ব্যবস্থা করে দেন। অপহরণের রাতেই তাঁরা সিদ্দিককে নিয়ে গোপালগঞ্জ যান।