একসময় পেশাজীবী সংগঠনগুলো স্বকীয়তা নিয়ে চলত। যে রাজনীতির প্রতিই সমর্থন থাকুক না কেন, পেশাজীবীরা পেশাগত বিষয়টিই অগ্রাধিকার দিতেন। দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতেন। কিন্তু এখন পেশাজীবী সংগঠনগুলো পেশাগত বিষয়ের চেয়ে দলীয় রাজনীতিকে মুখ্য ভাবে।
রাজনৈতিক কারণে অধিকাংশ পেশাজীবী সংগঠন ভাগ হয়ে গেছে। যেমন সাংবাদিক ইউনিয়ন। সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের পূর্বসূরিরা এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এরশাদের শাসনামল পর্যন্ত সব সাংবাদিক এক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতেন। কিন্তু নব্বই-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক আমলে’ তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরে ভাগ হয়ে গেলেন। একইভাবে শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসাবিদ, কৃষিবিদ ও প্রকৌশলীদের সংগঠনও হয় বিভক্ত হয়ে গেছে অথবা মূল সংগঠনের চেয়ে দলীয় ফোরাম অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।
আবার এসব দলীয় ফোরামেও উপদলীয় কোন্দল আছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে দুই পক্ষের উপদলীয় কোন্দল, হামলা, মামলা, প্রতিবাদ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। গত কয়েক বছর ধরেই এই সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে নানা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে আসছিল। কখনো নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি, কখনো ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক।
এবারে ভোটগ্রহণ পর্ব মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলেও পরে আওয়ামী ও জাতীয়তাবাদী—উভয় শিবিরে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা যায়। আওয়ামী শিবিরে প্যানেলের বাইরে যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তিনি আবার বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের স্ত্রী।
অন্যদিকে পুরো প্যানেলটি তাঁর ভাই ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের সমর্থক। অনেকে এটিকে ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ বলেও অভিহিত করেছেন। তবে সেই যুদ্ধটি ভোটের মধ্যে সীমিত থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা দেখা দিল যখন বহিরাগতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানাকে জয়ী ঘোষণা করতে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির প্রধানকে বাধ্য করেন। পরে অবশ্য সে ঘোষণা বাতিল করা হয়।
আওয়ামী শিবিরের এই সংঘাতের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আইনজীবীর ফোরাম নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট গণনায় না যাওয়ার নির্দেশ দেয়। অন্যরা এই নির্দেশ মানলেও সভাপতি প্রার্থী মাহাবুব উদ্দিন খোকন মানেননি।
ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সভাপতিসহ ৪টি ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী ফোরাম সম্পাদকসহ ১০টি পদ লাভ করে। স্বতন্ত্র সম্পাদক পদপ্রার্থী নাহিদ সুলতানা, যিনি নির্বাচন উপ কমিটির প্রধানকে তাঁকে জয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য করেন, পেয়েছেন মাত্র ২৬৯ ভোট।
এরপর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল জানিয়ে দেন, তাদের প্যানেলের নির্বাচিত কেউ শপথ নিতে পারবেন না। ৭ বার সম্পাদক পদে এবং প্রথমবার সভাপতি পদে নির্বাচিত মাহবুব উদ্দিন খোকন সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে সভাপতি হিসেবে শপথ নেন। এরপর জাতীয়তাবাদী ফোরাম থেকে খোকনকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ফোরামের দপ্তর সম্পাদক মো. জিয়াউর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের নির্দেশনা অমান্য করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ায় ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র সহসভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
কিন্তু মাহাবুব উদ্দিন খোকন এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘যেখানে ফোরামের গঠনতন্ত্রই নেই, সেখানে তারা আমার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কোনো বৈঠক হলে ফোরামের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে আমারও জানার কথা।’
এরপরই জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ভাগ হয়ে যায়। বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ সদস্যরা মনে করেন, নির্বাচনের ফলাফল বর্জন কিংবা খোকনকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। খোকনের সমর্থকেরা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে তাঁর পক্ষে মানববন্ধন করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ফোরামের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বসে দ্রুত অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। আবার সেই অনুরোধ লন্ডনের অনুমোদন নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে পাঠানো হয়।
বিএনপিপন্থী বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই সিদ্ধান্তের পেছনে খোকন-কামালের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও কাজ করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কায়সার কামাল হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খোকন আইনজীবী সমিতির সভাপতি হলে ফোরামের গুরুত্ব কমে যাবে, তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে এই যুক্তিও কাজ করতে পারে।
জনগণকে স্বপ্ন দেখানো অনেক দূরের কথা। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতেও যে তারা সক্ষম নন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির ওপর অব্যাহতির খড়্গই প্রমাণ। কিন্তু একটি অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহার কিংবা জবাবি দুঃখপ্রকাশের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ফাটল কমবে কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দেবে।
এরপর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন। পরে খোকনকে দেওয়া অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে ফোরামের দপ্তর সম্পাদক ও আইনজীবী সমিতির সভাপতির মধ্যে যে চিঠি বিনিময় হয়, সেটা আমাদের হস্তগত হয়েছে।
২৯ এপ্রিল দপ্তর সম্পাদকের লেখা চিঠিতে বলা হয়, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সম্মতিতে আপনার অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হলো।’ এর জবাবে একই দিন কায়সার কামালকে লেখা চিঠিতে খোকন বলেন, ‘২২ এপ্রিলের সংবাদ সম্মেলনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য প্রদান করেছি এবং যা আপনার অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে আমি উপলব্ধি করেছি। এবং সে কারণে আমি অনুতপ্ত ও দুঃখপ্রকাশ করছি।’
বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা গেছে, মাহাবুব উদ্দিন খোকনকে অব্যাহতি দেওয়া কিংবা প্রত্যাহার কোনোটাই কায়সার কামালের ইচ্ছেয় হয়নি। লন্ডনপ্রবাসী যেই ‘বড় ভাই’ অব্যাহতির নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনিই তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
আমাদের রাজনৈতিক দলের সব সিদ্ধান্ত ওপর থেকে আসে। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। তারা অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নেন, যার সঙ্গে দেশের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলোয় ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ‘বিরোধী দলের রাজনীতিকেও প্রশ্ন করে যেতে হবে’ শীর্ষক কলামে বিরোধী দলের প্রধানত বিএনপির বর্তমান রাজনীতি দুর্বলতাগুলো যথার্থভাবেই চিহ্নিত করেছেন।
তিনি লিখেছেন: ‘বিরোধী দলগুলোকে এটা বুঝতে হবে যে দলের কমিটি করা রাজনীতি নয়। দু-চারটা বড় সভা করা শুধু রাজনীতি নয়। বরং রাজনীতি যে শাসকের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন বয়ান তৈরি করা; শাসকের প্রতিটি ভুল ও গণবিরোধী কাজকে চ্যালেঞ্জ করা; সমাজের প্রতিটি অংশে বিশেষভাবে ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষক ও পেশাজীবীদের যুক্ত করা; বিকল্প সমাধান দেখানো; জনগণকে স্বপ্ন দেখানো; আশা তৈরি করা—এসব আজকের বিরোধী রাজনীতিতে অনুপস্থিত।’
জনগণকে স্বপ্ন দেখানো অনেক দূরের কথা। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতেও যে তারা সক্ষম নন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির ওপর অব্যাহতির খড়্গই প্রমাণ। কিন্তু একটি অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহার কিংবা জবাবি দুঃখপ্রকাশের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ফাটল কমবে কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দেবে।